Image description

ভূমিখেকো কথিত বিএনপি নেতা কাইয়ূমের ঘনিষ্ট সহযোগী মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। গামছা বিক্রেতা থেকে বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। কিভাবে তিনি এমন ধন ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন তিনি তা এখনো রহস্যময়। বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করে গেছেন মনির হোসেন। গড়ে তুলেছেন অবৈধ টাকার পাহাড়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখন আবার বিএনপির কাঁধে ভর করেছেন। 

অতীতের মতো এখনো বিএনপিকে ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। আর তাকে এই কাজে সহযোগিতা দিচ্ছেন বিএনপি নেতা বাড্ডার এম এ কাইয়ূম। গোল্ডেন মনির কাইয়ূমের সহযোগিতায় উত্তরখান-খিলক্ষেত থানার পাতিরা, বাউতার, তলনা, ডেলনা, বরুয়া এলাকায় গড়ে তুলেছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। মানবকণ্ঠ গোল্ডেন মনিরের উত্থানের কাহিনী খোঁজার চেষ্টা করে পেয়েছে নানা লোমহর্ষক তথ্য।

কে এই গোল্ডেন মনির: নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন মনির হোসেন। তার বাবা কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা সিরাজ মিয়া ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি ঢাকার নিউ মার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেট এলাকায় ফেরি করে লুঙ্গি-গামছা বিক্রি করতেন। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা মনির একসময় বাবার ব্যবসা (গামছা বিক্রি) শুরু করেন। 

রাজধানীর বাড্ডায় নানার বাসায় থেকে বড় হওয়া মনির মৌলভীবাজার থেকে কাপড় এনে বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করতেন। তারপর শুরু করেন ক্রোকারিজ সামগ্রীর ব্যবসা। সেই ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে অবৈধ ল্যাগেজ ব্যবসা শুরু করেন, যার আড়ালে মনির স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসায় জড়িয়ে যান। এরপর মনিরকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্পদিনেই হয়ে যান কোটিপতি। মনির হোসেন থেকে হয়ে যান ‘গোল্ডেন মনির’। 

এই মনিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সোনা চোরাচালান ও হুন্ডি কারবার, জমি দখল ও জালিয়াতি, মাদক, বিদেশি মুদ্রা ও অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগ ছিল। একটি গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ভোরে র‌্যাব গোল্ডেন মনিরের মেরুল বাড্ডায় বিলাস বহুল ছয়তলা বাড়ি থেকে নগদ এক কোটি নয় লাখ টাকা, চার লিটার মদ, আট কেজি সোনা (৬০০ ভরি), ৩২টি নকল সিল, একটি বিদেশি পিস্তল ও গুলি জব্দ করে। জব্দ করা হয় গোল্ডেন মনিরের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি, যার প্রতিটির বাজারমূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। অভিযানের পর র‌্যাব বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এগুলো হলোÑ মাদক, অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা। সব মামলায় মনিরের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। 

মনিরকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানায়, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক গোল্ডেন মনির। রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য প্লট হাতিয়ে নেন তিনি। আর সিআইডির তদন্তকারীরা বলছেন, মনিরের ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। বাড্ডা, নিকেতন, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা ও নিকুঞ্জে দুইশোর বেশি প্লট রয়েছে তার।

অস্ত্র মামলায় খালাস: সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত গোল্ডেন মনিরকে অস্ত্র মামলায় খালাস দিয়েছেন। রায়ে আদালত বলেছেন, নিজের ও স্ত্রীর নামে দুটি বৈধ অস্ত্র থাকা অবস্থায় আরেকটি অবৈধ অস্ত্র ঘরে রাখার ঘটনা স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। পুলিশও তদন্তে মনির ও তার স্ত্রীর নামে লাইসেন্স করা অস্ত্র পেয়েছিল। 

আদালত আরও বলেছেন, মনির হোসেনের শয়নকক্ষে খাটের তোশকের নিচ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান এ রায় দেন। তবে এতদিন রায়ের বিষয়টি প্রকাশ হয়নি। গত সপ্তাহে তা জানাজানি হয়। বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, অস্ত্র মামলায় মনির হোসেনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর পর্যালোচনা সাপেক্ষে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।

মানিলন্ডারিং মামলা সিআইডিতে: ২০২১ সালের মে মাসে গোল্ডেন মনিরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি। সেই মামলায় মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার, ছেলে রাফি হোসেন, মনিরের বোন নাসিমা আক্তার, ভগ্নিপতি মোহাম্মদ হাসান উদ্দিন, আরেক ভগ্নিপতি নাহিদ হাসান খান, মনিরের অটোকার সিলেকশনের জিএম আব্দুল হামিদ খান, তার অপরাধ কাজের সহযোগী ও ব্যবসায়িক পার্টনার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন, তার ভাই মোহাম্মদ হায়দার আলি, মোহাম্মদ শফিকুল শফিকের নাম রয়েছে। 

মামলার এজাহারে বলা হয়, অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থে মনির হোসেন স্ত্রী, ছেলে এবং তার নিজের নামে সরকারি ২০টিসহ ৩০টি প্লট, ১৫টি ভবন, একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান এবং দুটি গাড়ির শো-রুম করেছেন। ব্যাংকে তার নামে রয়েছে ৭৯১ কোটি পাঁচ লাখ ৯৬ হাজারের বেশি টাকা। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন আছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। 

একটি সূত্র বলছে, তদন্তে বেশ অগ্রগতি আছে। মনিরসহ এজাহারে থাকা সবার বিপুল সম্পদের খোঁজ মিলেছে, যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই চলছে। আর মনিরের বিরুদ্ধে থাকা বিশেষ ক্ষমতা আইন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। 

সিআইডি বলছে, মনির অবৈধ উপায়ে দিনে দিনে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এসব টাকায় কিনেছেন জমি, করেছেন বড় বড় শপিং মল। দিয়েছেন গাড়ির ব্যবসা। তার হাত ধরে বোন, বোনের স্বামীসহ অনেকে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মেরুল বাড্ডায় বিলাস বহুল ছয়তলা বাড়ি করেছেন। 

সূত্র আরও জানিয়েছে, মনিরের সব সম্পদই অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত। তদন্ত সংস্থা বলছে, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন ১৯৯৬ সালে সোনালী ব্যাংকের এয়ারপোর্ট শাখায় পিয়ন পদে চাকরি করার সময় গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এ সময় তিনি সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। পরে চাকরি ছেড়ে দেন। অপরাধের টাকায় রিয়াজ এবং গোল্ডেন মনির একসঙ্গে সম্পত্তি করেছেন। উত্তরার জমজম টাওয়ার, আল সাফা টাওয়ারসহ অনেক সম্পত্তি রয়েছে তাদের। তবে, কী পরিমাণ টাকা তারা অবৈধ উপায়ে উপার্জন করেছেন তা জানতে অধিক তদন্ত চলছে।

আরও মামলা আছে মনিরের বিরুদ্ধে: গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে মতিঝিল ও রমনা থানায় মাদকদ্রব্য ও দুদক আইনে পৃথক মামলা আছে। তাছাড়া রাজউকেরও একটি মামলা রয়েছে।