বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের হিসাব করা শ্রেণিস্বার্থের পূজারী অতি সাবধানী ব্যক্তিবর্গের হাতে ক্ষমতা চরমভাবে কেন্দ্রীভূত হলে আখেরে সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তির কর্মকান্ড বিনষ্টকারী হবেই। বিগত আমলে বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের হাতে চরম ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে একই বৃত্তের মধ্যে তৈরি করে উচ্চমার্গ ও নিম্নমার্গের শ্রেণী বৈষম্য। ক্ষমতাধর নিজেকে উচ্চমার্গীয় পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টায় ক্রমাগত বহিঃপ্রকাশ করে তার সুপ্রিম ইগো, যেখানে জনসেবা তথৈবচ।
একারণেই সাম্প্রতিককালে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানাতে গিয়ে একজন ইউএনও তার পাশে আরেকজন সরকারী কর্মচারী পুলিশ সদস্যকে দাঁড়াতে দিচ্ছেন না, যেন ইউএনও মহোদয় ব্রাহ্মণ আর সেই পুলিশ সদস্য শুদ্র শ্রেণীর সরকারি চাকর, পাশে দাঁড়ালে জাত যাবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক মনে করা সেই ইউএনও সাহেবের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্জিত সুপ্রিম ইগো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল, এবং তিনি ভুলে গিয়েছিলেন তিনি এবং সেই পুলিশ সদস্য দুজনই জনগণের চাকর। সরকারী চাকরিজীবীদের আন্তঃসার্ভিস সম্পর্কের ক্ষেত্রে সারাদেশে বেশিরভাগ প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের আচার-আচরণ সেই ইউএনও প্রতিনিধিত্ব করেছেন বললে খুব একটা ভুল হবে না।
“জনগণকে নয়, চেয়ারকে ভালোবাসুন”-এই যেন মূল মন্ত্র। এ কারণে জেলা পর্যায়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সভাপতি নয় এমন প্রোগ্রামে কোনকালেই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকেন না। প্রতিনিধি পাঠান। যেমন: জেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসির মাসিক বা ত্রৈমাসিক কনফারেন্সে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (DC) উপস্থিত থাকেন না কারণ সেই কনফারেন্সের সভাপতি ওই জেলার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি প্রতিনিধি পাঠান, স্বশরীরে উপস্থিত হলে নাকি (শুনেছি) ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মান মর্যাদা কমে যাবে। অথচ আইনে তার উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। কি বুঝলেন, জনগণের নিরাপত্তা আগে নাকি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ারের মান মর্যাদা? এমনটাই হয়ে এসেছে, এতকাল কেউ বলেনি তাই।
২০২০ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাতের অন্ধকারে কুড়িগ্রামের এক সাংবাদিককে ডিসি অফিসে তুলে এনে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল। এ ঘটনায় বিস্মিত হয়ে উচ্চ আদালত মন্তব্য করে বলেছিলেন “একজন সাংবাদিককে ধরতে মধ্যরাতে তার বাসায় ৪০ জনের বিশাল বাহিনী গেল, এ তো বিশাল ব্যাপার! তিনি কি দেশের সেরা সন্ত্রাসী?।” রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের সংবাদ অন্বেষণ ও উপস্থাপনের স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে আঘাত করার মাধ্যমে। জাতি হিসেবে আমরা অত্যন্ত অভাগা কারণ খাতা কলমে জনগণের সেবক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখে নেওয়ার মানসিকতা অত্যন্ত প্রকট। বাংলাদেশের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশার মূল কারণ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রেষণে সকল পর্যায়ের মন্ত্রণালয় দখল করে রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, সাহিত্য বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়া একজন ব্যক্তি যদি কোন দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হন তাহলে সেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বেই কারণ তিনি ডাক্তারদের দুঃখ কষ্ট বুঝবেন না এটাই স্বাভাবিক। এটা আমাদের দেশে হয়। বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদান করে গাড়ি বা আলাদা বাজেট সুবিধা পান না। অধিকন্তু, প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত অন্যান্য ক্যাডারে প্রমোশন সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার গতি শ্লথ করে রাখা হয়েছে। আপনি হতাশ কর্মকর্তার কাছে উজ্জীবিত সেবা আশা করেন কিভাবে? আপনি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে স্বাধীন সাংবাদিকের নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ চান কিভাবে? অপ্রতিহত জবাবদিহিহীন ক্ষমতা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে।
বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কার কাছে জবাবদিহি করেন আমরা জানতে চাই। জেলা আদালতের বিচারক তার বিচারিক কাজের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে দায়বদ্ধ। শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ক্যাডারের আমলার কাছে দায়বদ্ধ, স্বার্থ ক্যাডারে ডাক্তার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ক্যাডারের আমলার কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আরেক জন প্রশাসন ক্যাডারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিকট দায়বদ্ধ। এ কারণেই আমাদের দেশে জনসেবায় ক্ষমতার ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিটি সেক্টরে সামগ্রিকতার অংশগ্রহণের ন্যায্যতার নীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নাই।
এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ক্যাডারের সচিবদের বস (মন্ত্রী) হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতা ফলে মাঠপর্যায়ে জন সেবার নামে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দলের ঘৃণ্য এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত রাজনৈতিক পাণ্ডাদের পকেটে ঢুকে ছিল। উদাহরণ: প্রতিটি সরকারী কাজের টেন্ডার একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা পেয়েছেন, খাল বিল সরকারি পুকুরের মৎস্য চাষের ইজারা স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডাররা পেয়েছেন, স্বাস্থ্য খাতের টেন্ডার লুটপাটকারী রংপুরের মহী মিঠু গং পেয়েছেন, বালুমহল, জলমহল, নদী খনন, খাল খনন এমপি মন্ত্রীদের চেলাপান্ডারা হাত করেছেন। নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে প্রতিটি সেক্টরে।
বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসিক এবং তাত্ত্বিকভাবে বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশকে একটি আমদানি নির্ভর দেশে পরিণত করা হয়েছে। কুটির শিল্প ও হস্তশিল্প বিলুপ্ত প্রায় যা করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। অথচ দেশের যেকোন ক্রান্তিলগ্নে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন তারাই প্রকৃত ত্রাতা এবং অন্য প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের চরিত্র নষ্ট করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা এবং জনগণের ভোটাধিকার রাজনীতিবিদদের চরিত্র ঠিক রাখে এটাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঠিক ভাষ্য। অথচ বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হাইজ্যাক করার পিছনে সাবেক আমলা এইচ. টি ইমামের কারসাজি নিশ্চয় গবেষণার বিষয় নয়।
বিসিএস ক্যাডারদের স্বতন্ত্রতা জিম্মি করে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা যেন রাজনৈতিক দলের মন্ত্রীদের আজ্ঞাবহ হয়ে মাঠ পর্যায়ে জনগণের সেবার নামে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নষ্ট করতে না পারে সে বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। বিগত সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের আমলা নির্ভর রাষ্ট্রীয় কাঠামো একই সাথে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তারসহ সকল পেশার অধিকাংশ চাকরিজীবীদের হতাশাগ্রস্ত করে তাদের স্বতন্ত্র চরিত্র নষ্ট করেছে। প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রীয় সেবক তৈরি করতে পারে আর এর ব্যত্যয় হলেই উত্থান হবে স্বৈরশাসকের।
লেখক: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, নাটোর।
Comments