Image description

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম উল্লেখযোগ্যভাবে গতি পায়, কারণ নানা রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শক্তি প্রথমবারের মতো ধাপে ধাপে অবস্থান স্পষ্ট করতে থাকে। পাকিস্তানের পরাজয় কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

পাকিস্তান যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন তার মিত্রশক্তিগুলো যুদ্ধবিরতির দাবি তুলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আবারও ভেটো দেয়, ফলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ভেস্তে যায়। এতে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ আরও উন্মুক্ত হয়। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। মার্কিন নৌবাহিনীর ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।

ব্রিটেন মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।ইউরোপে বাংলাদেশ শরণার্থী সংকট নিয়ে প্রচার বাড়তে থাকে এবং জনমত বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত হতে থাকে।

সেদিন বিশ্বের প্রায় সব বড় সংবাদমাধ্যম—BBC, NBC, The Times, The Guardian—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রধান শিরোনাম করে। পাকিস্তানের পরাজয় সন্নিকটে—এমন বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়। 

ভারত ও ভুটানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি :
ভারত প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশ এখন একটি সার্বভৌম দেশ। একই দিনে ভারত বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জাতিসংঘে তুলে ধরে।
একই দিনে ভুটানও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মান্যতা দেওয়া শুরু হয়।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ :
৭ ডিসেম্বর কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি দল বিবির বাজার, ভাটপাড়া এবং বাঘেরচর দিয়ে এসে কুমিল্লা বিমানবন্দরের হানাদার ঘাঁটিতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। এরপর দুপুরের দিকে এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার সেনারা বিমানবন্দরের অবস্থান ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী কুমিল্লা দখলের লক্ষ্যে কুমিল্লা শহরের দিকে এগিয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর সিলেটে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩য় বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি ও ডাউকি সাব-সেক্টর ট্রুপসসহ রাধানগর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনে গোয়াইনঘাট হয়ে সালুটিকরে সিলেট বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হন। এদিন ভোরে সিলেট বিমানবন্দরে ছত্রীসেনা অবতরণ করায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। এর ফলে সিলেট বিমানবন্দর ও তৎসংলগ্ন স্থান যৌথ বাহিনীর দখলে চলে আসায় এই অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়।

৭ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় হানাদার বাহিনী পিছু হটে।

৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে আফসার বাহিনীর বড় একটি দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ভালুকা থানার উপর ত্রিমুখী আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় হানাদারদের সঙ্গে আফসার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদারেরা ভালুকা থানার অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যোশির নির্দেশে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর ব্যাপক আর্টিলারি হামলা চালায়। এরপর হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী হানাদার মুক্ত হয়। নোয়াখালী হানাদার মুক্ত হলে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে আটক করে মুক্তিযোদ্ধারা।

৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। এদিন রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানার পাশের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। ৭ ডিসেম্বর ভোরে গোপালগঞ্জ শহরে ঢুকে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধা।

৭ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও যৌথ বাহিনীর মধ্যে বগুড়া ও রংপুর সড়কের করতোয়া সেতুর দখল নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৩৫ জনের মতো সৈন্য হতাহত হয়।

৭ ডিসেম্বর শেরপুর হানাদার মুক্ত হয়।

৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা হানাদার মুক্ত হয়৷ এদিন দর্শনার দিক থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সাথে মুক্তিবাহিনী যোগ দিয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে এগিয়ে যায়। এদিন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আগমনের খবর শুনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর চলাচল বন্ধ করার জন্য আগেরদিন সন্ধ্যায় মাথাভাঙ্গা নদীর উপরের ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। এরপর দর্শনার দিক থেকে মিত্রবাহিনী চুয়াডাঙ্গায় এসে পৌঁছালে এদিন সন্ধ্যার মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা ছেড়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়।

৭ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ও সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মংলা ও সুন্দরবনের বিশাল এলাকা হানাদার মুক্ত করে।

সূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, একাদশ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।