Image description

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনসহ (ইভিএম) নির্বাচনী উপকরণগুলো সংরক্ষণে স্বতন্ত্র একটি ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই ইউনিটে থাকবে নিজস্ব ওয়্যারহাউজ, যেখানে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে যন্ত্রগুলোকে সংরক্ষণ করা হবে। থাকবে নিজস্ব জনবল। মেরামতে সক্ষমতা। ছোটখাটো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যাতে নিজস্ব জনবল দ্বারাই সম্পন্ন করা যায়, সে ব্যবস্থাও থাকবে। 

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউনিটটিকে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে নিজস্ব ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ঢাকার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে জমি চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। 

এদিকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) কার্যকারিতা বাড়াতে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যে ভোটযন্ত্রটির উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে ও কারিগরি উন্নয়ন করে এটিকে হালকা করতে চায় কমিশন। এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক সংস্থাটি দেশসেরা প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। নতুন যন্ত্রগুলোর ওজন কমানোর পাশাপাশি এতে কারিগরি উন্নয়ন তথা ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল) যুক্ত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। 

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম বলেন, আমরা সংরক্ষণ, মেরামত, টেকনলজি ট্রান্সফার, নিজস্ব জনবল তৈরি এই সব কিছু নিয়ে কাজ করছি। আমরা ইতোমধ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে জমি চেয়েছি। আশা করি পেয়ে যাবো। এতে আমাদের নিজস্ব অবকাঠামো, নিজস্ব ওয়্যারহাউজ এবং আমাদের সম্পূর্ণ একটা আলাদা ইউনিট হবে। ইভিএম বা নির্বাচনী উপকরণ যাতে সংরক্ষণ করতে পারি, যেন আমাদের ক্যাপাসিটি থাকে, পাশপাশি আমাদের নিজস্ব জনবল যাতে প্রাথমিক মেরামত, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি মেরামত যাতে করতে পারে তার প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ পরবর্তী এক বছরে ব্যবস্থা করবো। আপাতত জেলা প্রশাসকের কাছে জমি চেয়েছি। সেটা পেলে আামরা এটিকে ওয়্যারহাউজ হিসেবে ব্যবহার করবো। সম্পূর্ণভাবে একটি স্বনির্ভর ইউনিট হিসেবে তৈরি করব। এটি আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।

ইসি সচিব বলেন, যে কোনো প্রযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু করা হয়। এটি নির্ভর করে জন আকাক্সক্ষা ও তাদের মতামতের ওপর। আমরা এতটুকু বলতে পারি পরবর্তী যে নির্বাচনগুলো আছে, আমাদের কাছে রাত-দিন অনুরোধ আসছে, আমরা যেন ইভিএমে নির্বাচনগুলো করি। পরবর্তীতে স্থানীয় নির্বাচনগুলো ইভিএমে হবে। একটি নতুন প্রযুক্তির প্রতি মানুষের অনেক জিজ্ঞাসা থাকে। আমরা চেষ্টা করছি তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ যাতে এটি নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারে। যারা এটার বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা এটার সুবিধাভোগী আছেন, আমরা ব্যবহারকারী যারা আছি, সবাই এটা নিয়ে কাজ করছি। এখানে আরও কোনো ধরনের নতুন ফিচার যোগ করা যায়, আরও কিভাবে নির্ভরযোগ্য করা যায়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কিভাবে হচ্ছে, গ্লোবালি এটা গ্রহণযোগ্যতা কেমন এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। এটা যেহেতু প্রকল্প ছিল, তাই পরবর্তী এক বছর কোনো অর্থ বরাদ্দ ছাড়া মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। মেয়াদটা যদি বাড়ানো হয়, ইভিএমে কিভাবে আস্তে আস্তে আর উদ্ভাবনে যাব, কমিশনের নিজস্ব জনবল তৈরি, এটা কিভাবে সংরক্ষণ, কিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবো এবং এটার কারিগরি দিক কিভাবে সফলভাবে হ্যান্ডেল করতে পারি, সবকিছুই আমরা এই সময়ের মধ্যেই ঠিকঠাক করে ফেলব। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক-এগারো সরকারের সময়কার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তারা বুয়েট থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে মেশিন তৈরি করিয়ে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোটযন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরবর্তীতে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূলের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলে উন্নত মানের ইভিএম তৈরির সিদ্ধান্ত রেখে যায়।

২০১৭ সালে কেএম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্বে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টেরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেন তারা। এতে মেশিন প্রতি ব্যয় হয় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। হাতে নেয়া হয় তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প। প্রকল্প থেকে দেড় লাখের মতো ইভিএম কেনে রকিব কমিশন। কিন্তু  সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ব্যবস্থা না থাকায় সেই উন্নত মানের ইভিএম পাঁচ বছর যেতে না যেতেই অকেজো হওয়া শুরু করে। 

কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এসে প্রায় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অবশিষ্ট এক লাখ ১০ হাজারের মেশিনের মধ্যে অধিকাংশগুলোতে ধরা পড়ে নানা ধরনের ত্রুটি। কিন্তু মেরামতের জন্য নেই অর্থের যোগান। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলে বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। তবে ইসি বসে নেই। ভোটযন্ত্রটির উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে ও কারিগরি উন্নয়ন করে এটিকে হালকা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হায়দার আলী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. মাহফুজুল ইসলামের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। এতে ভিভিপ্যাট যুক্ত করা, ওজন কমানো ও ব্যয় কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডার বা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে পারে কমিশন। সবার মতামত পেলে ইভিএমের কারিগরি উন্নয়নে হাত দেবে ইসি।

ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, বর্তমানে এক লাখ ১০ হাজার ব্যবহার অনুপযোগী। আর ৪০ হাজারের মতো মেশিন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাচ্ছে। 

বাতিল ইভিএমগুলো কী হবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের দুই হাজার ৩৫ ইভিএমই তো ডিসপোজাল করা হয়নি। এগুলো কবে কী হবে! ইভিএমের কারিগরি উন্নয়ন, ব্যয় কমানো বা ওজন কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, কারিগরি উন্নয়ন তো হতে পারে। কিন্তু আসল কথা হলো দক্ষ লোকবলের অভাব। আমাদের প্রকল্প থাকলেও সেখানে দক্ষ কারিগরি লোকবল নেই। যারা ছোটখাটো সমস্যা হলে সমাধান করতে পারে। আগেও যে ইভিএম ছিল তখনো কারিগরি লোকবল নিয়ে ভাবনা হয়নি। 

বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনীয় লোকবল তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। ভিভিপ্যাট যুক্ত করা যেতে পারে।


মানবকণ্ঠ/এফআই