চিকিৎসার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ব্যাংককে যাওয়ার কথা ছিল বিএনপি নেতা ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে ইমিগ্রেশন থেকে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কেন তাকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে এর কোনো সদুত্তর দেননি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। একই অভিযোগ বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীরও।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দীর্ঘবছর বঞ্চিত ও নিগৃহীত হওয়া একজন সরকারি কর্মকর্তা গত সপ্তাহে জরুরি কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। কিন্তু ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাকে জানানো হয়- একটি গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স লাগবে। এক ঘণ্টা পরে তাকে পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়। একই পরিণতি ভোগ করতে হয় দেশের স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ীকেও। বিএনপির একনিষ্ঠ সমর্থক এই ব্যবসায়ী সেপ্টেম্বরে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। কিন্তু অক্টোবর মাসে আবারো তার বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।
কিন্তু হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পর ইমিগ্রেশন থেকে জানানো হয় তার পাসপোর্ট ব্লক করা হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তার পাসপোর্ট ব্লক করা হয়। কিন্তু কোন গোয়েন্দা সংস্থা বা কি রিপোর্টের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি ইমিগ্রেশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এভাবেই একের পর এক ইমিগ্রেশনে হয়রানির শিকার হচ্ছেন দেশের নাগরিকরা। বিশেষ করে বিএনপি এবং জুলাই আন্দোলনের পক্ষের লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। আর এর নেপথ্যে রয়েছেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান গোলাম রসুল। ডিআইজি থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে অতিরিক্ত আইজি হওয়া এই গোলাম রসুল এসবি প্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে যাচ্ছেতাই হচ্ছে ইমিগ্রেশনে। ফ্যাসিস্টবিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বড় ব্যবসায়ী, পত্রিকার সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষকে বিদেশে যাওয়ার সময় দেশের ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হচ্ছে তার ইশারাতেই। করা হচ্ছে হয়রানি। ‘আপনার বিরুদ্ধে ওই গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট রয়েছে’ প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই ধরনের এমন তথ্য দিচ্ছেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। বলা হচ্ছে- গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে আপনার পাসপোর্ট ব্লক করা হয়েছে। একই সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়েও রাখা হচ্ছে দেশের অনেক সম্মানিত নাগরিকদের।
আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অনিয়ম-অপরাধের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম এই গোলাম রসুল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু বন্দনা, পুলিশের গবেষণা ও উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সেন্টারের প্রস্তাব তিনি নিজ উদ্যোগেই তৈরি করেছিলেন। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে নিজেই মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়ে নিজেকে সরকারের একনিষ্ঠ প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এই গোলাম রসুল এখন ভোলপাল্টে অতিরিক্ত আইজি হয়ে ফ্যাসিস্টের দোসরদের দেশত্যাগে সহায়তা করছেন। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট বিরোধীদের হয়রানি করছেন। বাধা দিচ্ছেন বিদেশে যেতে। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ততা মিললেই আটকে দেয়া হচ্ছে। তার এই কর্মকাণ্ডে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও ক্ষুব্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১২তম ব্যাচের (১৯৯১) কর্মকর্তা মো. গোলাম রসুলের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদরে। এসবিতে যোগদানের আগে ১১ বছর তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, এসবিতে যোগদানের পর ফ্যাসিস্টের দোসরদের দেশত্যাগে সহায়তার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নামে-বেনামে অনেক সম্পদ গড়ার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী সরকারের পতনের ১৪ মাস পরেও পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট এসবি’র ইমিগ্রেশনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ শেখ হাসিনার আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে। কৌশলে ইমিগ্রেশন দিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ খুনি পুলিশ কর্মকর্তাদের ভারতসহ বিদেশ পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে ইমিগ্রেশনের আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাই। অন্যদিকে বিদেশগামী ও বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নাম ভাঙিয়ে হয়রানিও করছেন তারা। এতে অনেক বিদেশগামী যাত্রী শুধু বিদেশ যাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না, বরং বড় অঙ্কের টাকার ক্ষতির মধ্যেও পড়তে হচ্ছে ওই যাত্রীকে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। না হলে কারণ ছাড়াই কথিত গোয়েন্দা রিপোর্টের নাম করে হয়রানি চলতেই থাকবে। আইন উপদেষ্টার প্রতি তারা ঘটনার তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তা না হলে ক্ষুব্ধ জনগণ যে কোনো সময় এসবি অফিস ঘেরাও-এর মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাতে পারে। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করে ভুক্তভোগীরা বলেন, এর আগেও ইমিগ্রেশনের হয়রানির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। জনস্বার্থে অতি দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করেন তারা।
এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমিগ্রেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যারা ইমিগ্রেশনে কর্মরত রয়েছি তারা শুধু আদেশ পালন করি। আমাদের পক্ষে কোনো যাত্রীকে ফেরত পাঠানো বা যেতে দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয় কম্পিউটারে’।




Comments