Image description

বাড়ছে খেলাপি ঋণ। | গ্রাফিক্স

করোনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্নভাবে ছাড় দিয়েছে ঋণ পরিশোধে। এত এত সুবিধা দিয়েও কোনোভাবেই লাগাম টানা যায়নি খেলাপি ঋণের। ফলে চলতি বছরের তৃতীয় ও অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃতভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা বেশি। দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এর আগের প্রান্তিক অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ৯ মাস শেষে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের শুরুতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ টাকা। ২০২০ সালে দেশে আঘাত হানে মহামারি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস। এ মহামারির কারণে ব্যাংক ঋণ আদায়ে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে চলতি বছরের শুরুতে সুবিধাগুলো তুলে নেওয়া হয়। এরপর নিয়মিত বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ায় আর্থিক সংকট তৈরি হতে পারে বলে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করে বড় ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সিদ্ধান্তকে অবিবেচনাপ্রসূত আখ্যা দেয় অর্থনীতিবিদরা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল এতে করে ব্যাংকগুলোর খেলাপি কমবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সে আশা পূরণ করতে পারেনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বিজ্ঞপ্তির সুবিধা নেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ বাড়ল আরও ৯ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এ হিসেবে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩৭ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিতরণকৃত ঋণের মোট ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বরাবরের মতো খেলাপি ঋণের এগিয়ে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ মোট ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬ শতাংশের বেশি। বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ চার হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর পরিমাণ দুই হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে খেলাপি সবসময়ই একটি দুঃশ্চিন্তার কারণ। অনেক অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কমানো যায়নি এর পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংককে তাই নতুন করে ভাবতে হবে। খেলাপি আরও বাড়তে থাকলে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা তৈরি হবে। আইএমএফও এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাই আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।’

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যত দেখানো হয় প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে বেশিই হবে এর পরিমাণ। কিন্তু নানান ফাঁকফোকর দিয়ে ব্যাংকগুলো খেলাপি দেখায় না। এ কারণে খেলাপির পরিমাণ এখনও কম।’

তিনি বলেন, ‘করোনার দুই বছর ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও ব্যাংকের খাতায় ছিলেন ভালো গ্রাহক। অল্প কিছু পরিশোধ করেই সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) ভালো দেখিয়েছেন। এ অবস্থায় গত জুলাইয়ে আবদুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বড় ধরনের ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকগুলো যৌথভাবে খেলাপি ঋণ কমাতে জালিয়াতি করে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে ব্যাংকগুলো ২৮ বছর পর্যন্ত। সেই নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে ১০-৩০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে হতো। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।

এ ছাড়াও এসব ঋণ পুনঃতফসিল করে আবার নতুন ঋণের আবেদনও করা যাবে বলে সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীরা এসব সুযোগের অপব্যবহার করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা।