Image description

সত্য আহরণে ডিউইর পাঁচটি সোপান রয়েছে, এটি সক্রিয়তামূলক পরীক্ষার অংশ এই প্রক্রিয়া বাস্তব কর্মের ভেতর দিয়ে তথ্য বা ধারণাটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। পাঁচটি সোপান হলো- ১। সক্রিয়তা: ব্যক্তি কোনো কাজ সম্পাদন করতে করতে ২। সমস্যা: হঠাৎ বাধাপ্রাপ্ত হলে সমস্যা দেখা দেয়। তখন তার সমাধানের জন্য। ৩। তথ্য: সে নানা তথ্য মনে মনে আয়ত্ত করে। ৪। প্রকল্প: পরে তার মধ্যে থেকে একটি তথ্য সে বেছে নেয়। ৫। পরীক্ষণ: সেটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা বিচার ও অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।

শিক্ষার সামাজিক দিক ও গণতন্ত্র: শিক্ষার সামাজিক দিকটি ডিউই খুব গুরুত্বারোপ করেন। ডিউইর মতে ব্যক্তির বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশ সমাজের মধ্য দিয়েই ঘটে থাকে। সামাজিক পরিবেশ ছাড়া কোনো শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটতে পারে না। সমাজে অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে শিশুর যদি স্বাভাবিক সম্পর্ক বা ভাবের আদান, প্রদান ও ক্রিয়া ঘটে। এবং সে ক্রিয়া থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনই হলো শিক্ষা। এই যে ব্যক্তির সাথে সমাজের যৌথ অভিজ্ঞতার চর্চা, সে চর্চা যত বাড়বে তাতে ব্যক্তি ও সমাজের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটবে। সমাজের সাথে ব্যক্তির যৌথ অভিজ্ঞতা চর্চার এই মাধ্যম সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে গণতান্ত্রিক সমাজে। গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা বাধাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারে। ডিউইর মতে শিক্ষাই হলো একটি সমাজিক প্রক্রিয়া। শিক্ষার পূর্ণতা ও সার্থকতা নির্ভর করে আদর্শ সামাজিক পরিবেশের উপর।

বিদ্যালয়ই সমাজ: জন ডিউইর মতে প্রকৃত সামাজিক পরিবেশ ছাড়া সমস্ত শিক্ষাই অসম্পূর্ণ ও কৃত্রিম। কিন্তু গতানুগতিক স্কুলগুলোতে এই অতি প্রয়োজনীয় সত্যকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয়। অর্থাৎ গতানুগতিক স্কুলগুলো সামাজিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আলাদা করে রাখা হয়, সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখা হয়। সমাজ জীবনের জন্য অভিজ্ঞতা, আচরণ, মনোভাব ইত্যাদি শিক্ষার্থীকে শেখাবার কোনোরূপ আয়োজন সেখানে থাকে না। এর ফলে শিক্ষার্থী যখন সমাজ জীবনে প্রবেশ করে তখন সেই সামাজিক পরিবেশে অনুপযোগী ও অক্ষম হয়ে পড়ে। ডিউইর মতে স্কুল হলো সমাজের প্রতিচ্ছবি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামাজিক পরিবেশ থেকে আলাদা হতে পারে না। শিক্ষার্থীকে সমাজ জীবনের জন্য তৈরি করা শিক্ষার অন্তর্গত। শিশুকে কোনো নির্দিষ্ট ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না। 

ডিউই আরো বলেন কোনো অনির্দিষ্ট বস্তুকে কাল্পনিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করা শিক্ষার লক্ষ্য রূপে স্থাপন করা চলে না। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শিশুকে তার পূর্ণ জীবনের জন্য প্রস্তুত করা। আর বিদ্যালয় শিশুকে জীবনের জন্য তৈরি করবে। শৃঙ্খলার সমস্যাকে ডিউই কোনো সমস্যা হিসেবে প্রাধান্য দেন নাই। কারণ ডিউইর মতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি সত্যিকারের সমাজধর্মী পরিবেশে সৃষ্টি হয় তাহলে শৃঙ্খলা স্বাভাবিক ও স্বপ্রণোদিত থাকবে। শৃঙ্খলা রক্ষা সেখানেই সমস্যা হিসেবে রয়েছে, যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অসমাজধর্মী পরিবেশে রয়েছে বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। সে পরিবেশে শিক্ষার্থী কোনো স্বাভাবিক প্রেরণা পান না। 

ডিউইর আগ্রহ তত্ত্ব: ডিউইর মতে আমাদের অহংসত্তা থেকে যে স্বাভাবিক প্রেরণা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেরিয়ে আসে তা থেকেই জš§ায় আগ্রহ। অর্থাৎ ব্যক্তির নিজস্ব বিকাশ পথের অভিমুখে অবস্থিত কোনো কিছুর প্রতি অহংসত্তা প্রকাশ করাই হচ্ছে আগ্রহ। এই থেকে প্রমাণিত যে আগ্রহ ও প্রচেষ্টা পরস্পর বিরোধী নয়, পরস্পর সহায়ক। আগ্রহের প্রকাশ যত বাড়বে, তত প্রচেষ্টাও জাগ্রত হবে। আগ্রহ প্রকৃতপক্ষে আত্ম-অভিব্যক্তিমূলক আচরণই, যার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির বিকাশ প্রচেষ্টা অন্তর্গত প্রবণতা অনুযায়ী আত্মপ্রকাশ করে থাকে। এই আত্মপ্রকাশেই হচ্ছে আগ্রহ। 

ডিউইর শিক্ষা পদ্ধতি: ডিউইর শিক্ষাপদ্ধতি তার নিজস্ব দর্শন তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। তার শিক্ষা দর্শনে মনোবৈজ্ঞানিক ও জীবতত্ত্বমূলক আবিষ্কারগুলোকেও যুক্ত করেন। এবং দীর্ঘসময় ধরে তার শিক্ষা দর্শনের তত্ত্বগুলোকে দীর্ঘ পরীক্ষা করার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। তার মতে শিক্ষা পদ্ধতি হওয়া উচিত শিক্ষার্থীর সর্বাধিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। শিক্ষা হলো একজন শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়া চলাকালীন নিয়মের বেড়াজালে বাধাগ্রস্ত করা হলে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং শিক্ষা পদ্ধতিতে শিশুকে নিয়ন্ত্রণের কোনো স্থান নয়। শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থই হলো শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করা। সক্রিয়তা হবে শিশু শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম। যা শিশু পাঁচটি সোপান প্রক্রিয়ায় আবিষ্কার ও আহরণ করবে।

ডিউইর স্কুল বা ল্যাবরেটরি স্কুল: ডিউইর শিক্ষা দর্শনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য তিনি এই বিদ্যালয়টি প্রতিস্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়টিতে ডিউই তার আধুনিক সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করে তার কার্যকারিতা যাচাই করেন। এই বিদ্যালয়ে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কিছুই ছিল না। প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমের পরিবেশ থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তক কিছুই ছিল না। কোনো প্রকার নিয়ম-নীতি বাধা, শাস্তি কিছুই ছিল না। সেজন্য ডিউইর বিদ্যালয়ে শেখানো হতো সহযোগিতা ও পারস্পরিক প্রীতিময় আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে। 
অর্থাৎ তার মতাদর্শ মতে শিশুর শিক্ষা যে যে তার জীবনের প্রস্তুতির জন্য সে ব্যবস্থায় তিনি করেছেন। যৌথ প্রচেষ্টা ও সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই যে শিশুর শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে সেটি ডিউইর ল্যাবরেটরি স্কুলে ছিল। 

তিনি স্কুলকে গড়ে তুলেছেন সমাজ রূপে, যাতে শিশু সমাজের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিত হতে পারে। এবং তার ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। যার পরে শিক্ষার্থীরা সামাজিক অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চয় করতে পারতো। 

ডিউইর শিক্ষাঘটিত দর্শন কোনো কল্পনাজনিত কিংবা অনুভূতি প্রসূত নয়। সবগুলো দর্শনগত চিন্তা মনোবৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের উপর প্রতিষ্ঠিত। ডিউইর যুক্তি ও প্রমাণ সকল মতবাদের পেছনে স্পষ্টত উল্লেখ থাকে। এই পদ্ধতিতে ডিউইর মতবাদ সর্বজন যেভাবে গ্রহণ করেছে। অপরদিকে শিক্ষা শাস্ত্রকে জল্পনা-কল্পনার স্তর থেকে তুলে বিজ্ঞানের পর্যায়ে প্রতিস্থাপন করেছেন। শিক্ষার সকল প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙে অভিনব মতবাদ দিয়ে শিক্ষার মর্যাদা ও প্রয়োজনকে বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং শিক্ষাকে সকল মানুষের জন্য গণতান্ত্রিক সর্বজনীন আদর্শ হিসেবে মতবাদ দিয়েছেন। 

সুতরাং আজকের সময়ে ডিউইর শিক্ষা দর্শন অনুসরণ করা অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ডিউইর যে শিশু শিক্ষার প্রক্রিয়া দেখিয়েছেন, সেটির উপর ভিত্তি করে শিশু শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। প্রচলিত শিক্ষার আয়োজনে শিশু শিক্ষার ব্যবস্থা জরাজীর্ণ এতে শিশু আগ্রহ ও প্রচেষ্টাকে জাগ্রত করতে পারছে না। বরং প্রচলিত শিক্ষার পরিবেশে শিশুর মধ্যে যেটুকু আগ্রহ, প্রচেষ্টা নিজ থেকে জš§ায় সেটিও নির্গত হতে থাকে। ডিউইর সমগ্র শিক্ষা দর্শন শিক্ষার সংকটকে তো দূর করবেই পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত ও অত্যাধুনিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। যার ফলে শিক্ষা গ্রহণের প্রতি শিক্ষার্থীদের যে প্রকৃত আগ্রহ সেটি কার্যকর হবে। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি