Image description

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বার বার প্রত্যাশা করেছে মানুষ। এও প্রত্যাশা করেছে, দেশ ও জাতি গঠনে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এদের মাধ্যমে বড় ধরনের জাগরণ ঘটবে। দেশের উন্নয়নসহ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা কেবলই হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশটা কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারছে না। জনগণ কেবল অসহায়ের মতো দেখছে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একে অপরের প্রতি আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ আর আক্রোশ প্রতিহিংসাপ্রবণ বক্তব্য, যে আক্রোশ আক্রমণের মধ্যে দলীয় ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তিবিদ্বেষ, ব্যক্তি কুৎসা অতিমাত্রায় ফুটে ওঠে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারো অস্থির হতে শুরু করেছে। 

তবে এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন যে, এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কখনই সুসম্পর্ক তো দূরের কথা, স্বাভাবিক সম্পর্কও ছিল না। তারা একে অপরকে শত্রু ভাবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়। সব সময় তাদের মধ্যে প্রতিহিংসা কাজ করে। এই স্বাভাবিক সম্পর্ক না থাকার কারণে সংস্কৃতিগতভাবে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেমন সমৃদ্ধ হতে পারেনি, ঠিক তেমনি দেশ, জনগণ, উন্নয়ন এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছে বার বার। উভয় দলের সহনশীল ও উদার মনোভাব একে অপরের প্রতি থাকতে হবে। এই সংস্কৃতিও ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বিরোধী পক্ষেরও উচিত সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করলে রাজনৈতিক দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।

এই বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবের কাছে দেশের সবকিছু জিম্মি হয়ে পড়বে। এর প্রধান কারণ ক্ষমতার লোভ। দেশে যত রাজনৈতিক দল রয়েছে, সবাই ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় যাওয়াই যদি একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তবে সেক্ষেত্রে জনগণ উপেক্ষিত হবেই। আর সংঘর্ষ, হানাহানিও বন্ধ হবে না। এত সমস্যা, সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার মধ্যেও আমরা চাই দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারা গড়ে উঠুক। স্বাধীনতার অনেক স্বপ্নের একটি ছিল স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। যেখানে মানবিক অধিকার সমুন্নত থাকবে। বস্তুত তা হয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর একদল লোক মেতে ওঠে লুণ্ঠন আর হত্যায়। 

সমাজে বিশৃঙ্খলার বীজ রোপিত হয়। সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হতে শুরু করে। আমাদের সামাজিক অধঃপতনের অনেক কারণ। তবে অন্যতম কারণ বৈষম্য। সমাজে নানা ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। এর মধ্যে ধর্মীয় এবং অর্থনীতি-এই বিশেষ দুটি কারণে সমাজ সবসময় অস্থিতিশীল থাকে। চলমান অসহিষ্ণুতার পেছনেও এ দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করি। বিগত চার দশকে এদেশে এক শ্রেণির লুটেরা, লুম্পেন সম্পদের পাহাড় গড়েছে। অপরদিকে মধ্যবিত্তের অনেকেই নেমে গেছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর্থিক অসঙ্গতি সাধারণের মধ্যে সার্বক্ষণিক চাপা ক্ষোভ তৈরি করছে। কাঙ্ক্ষিত জীবন অর্জনে ব্যর্থতা সমাজে তৈরি করছে অসম প্রতিযোগিতা। বেকারত্ব সৃষ্টি করছে হতাশা। একই সমাজে উচ্চ শ্রেণির বর্ণাঢ্য জীবন নিম্নবিত্তকে ঈর্শাকাতর করছে। প্রেমে পরাজয় জন্ম দিয়েছে প্রতিহিংসার। ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে বেড়েছে উন্মাদনা। অযোগ্য ব্যক্তির উত্থান এবং যোগ্যতমের পতনে তৈরি হয়েছে বিভেদ। 

সমাজের এই অসম বাস্তবতা সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। তারা মানসিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। দেশের সমাজ জীবন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছে রাষ্ট্র পরিচালকগণ। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে আর্থিক বৈষম্য। এদেশের  বেশির ভাগ মানুষ যেখানে মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খায়, সেখানে লুটেরা শ্রেণি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তবৈভবে আয়েশি জীবনযাপন করে। তারা আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কানাডা, মালয়েশিয়া, লন্ডনে সেকেন্ড হোম গড়ে তোলেন। হাওয়া বদলাতে উড়াল দিয়ে চলে যান পৃথিবীর নামি-দামি সৈকতে। বিনোদনের জন্য বেছে নেন জগৎসেরা সব এমাউজমেন্ট হোটেল। তাদের ব্যাংক হিসাবে থাকে কোটি  কোটি টাকা। অপরদিকে দেশের সাধারণ নাগরিক তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না। চিকিৎসার খরচ জোটে না। করতে পারে না মাথাগোঁজার একটু খানি ঠাঁই। জীবন-যাপনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তবু শাসকগোষ্ঠী উন্নয়ন-এর জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন গণমাধ্যম আর রাজনীতির ময়দানে।

গত কয়েক দশক ধরে উন্নয়ন শব্দটি বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদগণ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলে উন্নয়নকে ফিতে দিয়ে মাপবার চেষ্টা করেন। অথচ তারা জানেন না এদেশে একজন পোশাক শিল্প শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত? এই সামান্য টাকায় একজন মানুষের পরিবার চলে কী করে? তারা খোঁজ রাখেন না দেশের এটিএম বুথগুলোয় যারা সিকিউরিটির জব করেন, তাদের। তারা জানেন না, গ্রামে কৃষিক্ষেত্র থেকে আয় দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসায় অনেক কৃষক নগরে পাড়ি জমাচ্ছেন। শহরে এসে রিকশাচালক বা দিনমজুরের কাজ করে কোনোমতে জীবন চালাচ্ছেন। 

বর্তমান সমাজে চারপাশে এত অন্যায়, বৈষম্য, বিভেদ সাধারণকে মনে মনে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সেজন্য তুচ্ছ ঘটনাতেও হিংস্র হয়ে উঠতে দেখা যায়। মানুষের ভেতর থেকে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই নিষ্ঠুর, পাশবিক হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষ এখন তার ক্ষুব্ধতাকে কোথাও না কোথাও উগরে দিতে চায়। যা আমরা মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে দেখতে পাই। সুযোগ পেলেই সে এই কাজটি করে। কারণ অন্যকিছু নয়। মূলত পেশি শক্তিই হয়ে উঠছে ব্যক্তির কাছে ন্যায্যতার অন্যতম হাতিয়ার। তাই, খুনের মতো অমার্জনীয় অপরাধ করতে কেউ দ্বিধা করছে না। সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার পেছনে রাজনীতির দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। গত তিন তিনটে নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গণতন্ত্র হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। সাধারণ মানুষ আইনানুগ সহায়তা পায়নি। হত্যা, গুম, খুনের কোনো বিচার হয়নি। অসহায় মানুষ নির্যাতিত হয়েছে।

ধর্ষিত নারী পায়নি সুবিচার। রাজনৈতিক কর্মীরা জবর-দখল করে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য। ফুটপাতের ভিখারিকেও চাঁদা দিতে হয়েছে। খুনি, অত্যাচারী সমাজে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেন না তাদের ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সনদ। সরকারবিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতারা পালিয়ে বেড়িয়েছে। সরকার অনেককে করেছে দেশান্তরী। উক্ত বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না, তবে খুঁজতে হবে মুক্তির উপায়। সদ্য শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তিন দিন দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। 

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। মাঝের দিনগুলোতে ঢাকাসহ সারা দেশে চুরি, ডাকাতি, হত্যাসহ অনাকাক্সিক্ষত অনেক ঘটনা ঘটেছে। সরকার গঠনের পর চুরি, ডাকাতি কমলেও হত্যাযজ্ঞ থামেনি। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। হত্যাযজ্ঞ থামাতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এককভাবে দায় দেয়া যাবে না। আমরা জানি, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিতর্কিত হওয়ায় বিদ্যমান পুলিশের দায়িত্ব পালনে পূর্ণ পেশাদারি হয়ে উঠতে পারছে না। 

আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিহিংসাপরায়ণতা শান্তি আনতে পারে না। শান্তি আসে অহিংসায়। আমাদের অনেক ক্ষোভ আছে, না পাওয়ার কষ্ট আছে, হারানোর বেদনা আছে। কিন্তু প্রতিহিংসা এর কোনোটারই সমাধান নয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যে হানাহানি আর রেষারেষির মধ্যে কাটিয়ে দিলাম। এতে কী পেলাম? প্রাপ্তি এটুকুই যে, দেশ তার উজ্জ্বলতা নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, জনগণ মুখ-থুবড়ে পড়ে আছে। ভঙ্গুর ও ঋণনির্ভর অর্থনীতি আমাদের কাঁধে। আমরা নামেই ‘এশিয়ার বাঘ’ অথচ দাঁড়াতে চাইলেও দাঁড়াতে পারছি না। আমাদের মেরুদণ্ড সোজা করার সাহস জোগাবার যেন কেউ নেই। কিন্তু বাংলাদেশকে তো তার কর্মসুষমা নিয়ে, ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়াতেই হবে। কেবল নামেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হলে চলবে না। সে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে।

একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে দিন দিনই বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে বিদেশিরা ভয়ে পালিয়ে যাবে- তা হতে দেয়া যায় না। প্রতিহিংসার রাজনীতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও ভাবমূর্তির জন্য একটি বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে কারণে এখনই তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নতুবা আজ যা বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘটিত হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে তা নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রতিহিংসাতেই শেষ হতে দেখা যায়। সুতরাং আমাদের মনে রাখতেই হবে, প্রতিহিংসাপরায়ণতা শান্তি আনতে পারে না। শান্তি আসে অহিংসায়। শান্তি আসে সমঝোতায়।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট