Image description

বই হচ্ছে একটি সভ্যতার দর্পণ। বইয়ের মাধমে আমরা পরিচিত হই নতুন নতুন চিন্তা জগতের সাথে। বই হচ্ছে জ্ঞানের বাহন যা আপনাকে চালিত করে জ্ঞানের পথে। বই হলো জ্ঞানের সেরা।

জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে বই আমাদের চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি গঠনে অসামান্য ভ‚মিকা রেখেছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার দলিল হিসাবে বইয়ের আবির্ভাব ঘটে। এটি মানব মস্তিষ্কের সৃজনশীলতার প্রতিফলন এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞান সংরক্ষণের মাধ্যম। স্মার্টফোনের ‘দৃশ্যমুখর অস্থিরতা’ থেকে মুক্তি দিতে পারে বই। কমবে উদ্বেগ, ফিরে আসবে মানসিক স্থিরতা। মনোরোগের চিকিৎসায় ফলপ্রসূ হচ্ছে ‘বিব্লিওথেরাপি’।

মহাকবি গ্যাটে পাঠের মাধ্যমেই অপার ও নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতেন। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, কিন্তু সেই তুলনায় বই পড়া মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। ‘বই পড়া’ প্রবন্ধের লেখক প্রমথ চৌধুরী স্বেচ্ছায় বই পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আমাদের সমাজব্যবস্থা আমাদের সেই সুযোগটি দেয় না। আমরা সবাই অর্থ উপার্জনের চিন্তায় মশগুল। তাই যে বই পড়লে পেশাগত উপকার হবে বলে আমরা ভাবি, শুধু সেই বই-ই পড়ি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের চিকিৎসকদের পরামর্শ, সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বই পড়ুন। শৈশব ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় এমনটা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। 

একই সঙ্গে বই পড়ার মাধ্যমে শিশু ও মা-বাবার মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। বাড়িতে পড়ার অভ্যাস থাকলে স্কুলে শিশুর পড়া ও অন্যান্য কর্মক্ষমতা বাড়ে। তৈরি হয় যোগাযোগ দক্ষতা, বাড়ে আত্মসম্মান। বই শিশুর মস্তিষ্ককে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে। আজ থেকে পাঁচ বছর পর আপনি কোথায় যাবেন তা নির্ভর করবে এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন, কোন ধরনের মানুষের সাথে মেলামেশা করছেন সেটার উপর। মিসরের প্যাপিরাস স্ক্রোল থেকে শুরু করে চীনের বাঁশের পুস্তক এবং ভারতের পুঁথি, সবই মানবজাতির ইতিহাসের মূল্যবান অংশ। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ তার অভিজ্ঞতা ও আবিষ্কারকে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেছে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনকে ব্যস্ত রাখার উপায় হিসেবে বই ও ম্যাগাজিন পড়ার পরামর্শ দিয়েছে। গবেষণার চূড়ান্ত প্রমাণ এখনো হাতে না এলেও আভাস মিলেছে, বই পড়ার অভ্যাস থাকলে আলঝেইমারের মতো রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হয়ে যায়। বয়স্ক যারা প্রতিদিন সুডোকু বা গণিতের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান, তাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঠিক থাকে, উন্নত হয়। তাই আপনি যত আগে পড়া শুরু করবেন, আপনার জন্য তত ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের রাশ ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সেন্টার ২০১৩ সালে একটি গবেষণা চালায়, যেখানে বলা হয়েছে, যারা সারা জীবন বই পড়ার মতো কার্যকলাপে যুক্ত থাকেন, তাদের মস্তিষ্ক ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে ভালো থাকে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের চাপের স্তর জানতে যোগব্যায়াম, কৌতুক ও বই পড়ার প্রভাব পরিমাপ করা হয়। সেই সমীক্ষায় দেখা যায়, দিনে ৩০ মিনিট বই পড়লে রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন স্থির থাকে। মনস্তাত্তি¡ক সংকট কমে যায়।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলে ও সত্য যে, আমাদের এই প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার প্রতি প্রবল একটা অনীহা তৈরি হচ্ছে। বই পড়ার অভ্যাসটা দিন দিন কমেই যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের উপর। যারা অধিক পরিমাণে বিদেশি ভাষা পড়ে তাদের ব্রেইনের বৃদ্ধি সেরিব্রাল কর্টেক্স এবং হিপোক্যাম্পাস এই দুই অংশে বেশি ঘটে। এই বৃদ্ধি নির্ভর করে যত বেশি চেষ্টা এবং অনুশীলন করা হয় তার উপর। গল্পের গঠন ব্রেইনকে সিকোয়েন্স অনুযায়ী ভাবতে সাহায্য করে এবং মনোযোগ বাড়ায়। প্রতিটা গল্পের শুরু মধ্য অংশ এবং শেষ আছে। এই কাঠামোর কারণে ব্রেইন সিকোয়েন্স অনুযায়ী ভাবতে বাধ্য হয়। এবং কার্য-কারণের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মস্তিষ্কের অ্যাটেনশান স্পানগুলো বাড়ে ফলে মনোযোগের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। পড়ার অভ্যাস আমাদের ব্রেইনের সাদা অংশের আয়তন বাড়িয়ে দেয় ফলে ব্রেইনের উন্নতি ঘটে। গভীরে পাঠ সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয় যারা মগ্ন হয়ে পড়াশোনা করে তারা বাস্তব জীবনে অধিক সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। বই পড়ার অভ্যাসে আক্ষরিক অর্থে মন পরিবর্তন হয়। এমআরআই স্ক্যানার ব্যবহার করে গবেষকরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পড়লে অনুরণিত হয় মস্তিষ্কের নিউরন। পড়ার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউরন নেটওয়ার্ক শক্তিশালী ও পরিশীলিত হয়। ২০১৩ সালের এক গবেষণা থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

গবেষকরা মস্তিষ্কের প্রভাব জানতে উপন্যাস পড়ার সময় মানব মস্তিষ্কের এমআরআই স্ক্যান করেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা ৯ দিন ধরে পম্পেই নামের একটি উপন্যাস পড়েন। গল্পের উত্তেজনাকর নানান বিষয় পড়ার সময় মস্তিষ্কের নানান অংশে সক্রিয় ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। মস্তিষ্কের স্ক্যান থেকে জানা যায়, বই পড়লে মস্তিষ্কের সংযোগ বৃদ্ধি পায়। সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্সের অংশে পরিবর্তন দেখা যায়। মস্তিষ্কের এই অংশ চলাফেরা ও ব্যথার মতো শারীরিক সংবেদনে প্রতিক্রিয়া জানায়। যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে মনের প্রসারতা দরকার যা কেবলমাত্র বই পাঠের অভ্যাসের মাধ্যমেই সম্ভব। একজন সুশিক্ষিত মানুষ সকল নীচুতা, স্পর্শকাতরতা এবং হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে। সে নিজের জীবনের মধু নিজে আস্বাদন করতে পারে। বই-ই মানুষের সার্বক্ষণিক এবং শ্রেষ্ঠবন্ধু।

ওমর খৈয়াম বলেছেন, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।” প্রত্যেক ধর্মেই জ্ঞান অর্জনের প্রতি বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলী একটা কথা বলেছিলেন যে, “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।” বই শুধু জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের জীবন ও সমাজের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ধর্মীয় গ্রন্থগুলো মানুষকে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখাতে ভূমিকা রেখেছে, আবার দর্শনের বইগুলো মানব সমাজকে নতুন চিন্তাভাবনার পথ দেখিয়েছে। শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ কিংবা টলস্টয়ের রচনাগুলো কেবল সাহিত্যিক ধারা নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। আপনাকে অবশ্যই পাঠ্যবইও পড়তে হবে।

মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিন্তা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মননশীলতার বিকাশে সেতুবন্ধন রচনা করেছে বই। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর বই হয়ে উঠেছে মানুষের নিত্যসঙ্গী। একটি গ্রহণযোগ্য বিষয়কে ধারণ করে একটি বই চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে। জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বইয়ের ভ‚মিকা অপরিসীম। রাতে ঘুমানোর আগে চিকিৎসকরা মুঠোফোনের পরিবর্তে ছাপা বই পড়তে পরামর্শ দেন। নিয়মিত বই পড়লে কমে আসে বিষণ্নতার উপসর্গ। বই পড়লে আয়ু বাড়ে, প্রায় ১২ বছর ধরে চলা এক গবেষণা থেকে এমন তথ্য জানা যায়। ৩ হাজার ৬৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণকারীর ওপর চালানো একটি জরিপে দেখা যায়, যারা বই পড়েন, তারা বই না-পড়–য়াদের তুলনায় প্রায় দুই বছর বেশি বেঁচে থাকেন। যারা প্রতি সপ্তাহে ৩০ মিনিট বই পড়েন, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ২৩ শতাংশ বেশি।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সুস্থ ও সভ্য সমাজ গঠনে গ্রন্থ পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, আলোকিত জীবন গঠনে বইয়ের ভূমিকা খুবই ব্যাপক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। পাঠাভ্যাস জাতিকে মেধা ও মননশীল হিসেবে গড়ে তুলতে এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে থাকে। সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই আসুন, ‘পড়লে বই আলোকিত হই’ এই স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি পাঠমুখী পরিবেশ ও সুশীল সমাজ গঠনে সবাই মনোযোগী হই। সেদিন বেশি দূরে নয়, পাঠমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেই আমরা বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে মর্যাদার আসন লাভে সক্ষম হব।

লেখক: শিক্ষার্থী ও প্রাবন্ধিক