Image description

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘যারা নিষিদ্ধ সংগঠন, গণহত্যার আসামি ও ফ্যাসিস্টদের প্রচার প্রচারণা করার সুযোগ করে দিবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিষিদ্ধ সংগঠন ও ফ্যাসিস্টদের প্রচার-প্রচারণার বিষয়ে মিডিয়ার প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টার এ হুঁশিয়ারি নিয়ে নানান আলোচনা ও বিতর্ক দেখা যাচ্ছে।

গণমাধ্যমে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন, গণহত্যার আসামি ও ফ্যাসিস্টদের প্রচার’ নিয়ে আলাপ-আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের সঞ্চালিত একটি টকশোকে ঘিরে। গত ৭ নভেম্বর রাতে অতিথি হিসাবে যুক্ত থাকার কথা ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের অতিথি হয়ে আসার ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বিষয়টিকে ঘিরে ফেসবুকে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।

গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনরত  শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের উপর বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। এসব কারণ উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং এই আইনের তফসিল-২-এ এই ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একাধিক আইনজীবী বলেছেন, যেসব আইনের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়, সেই আইনগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে গত ২৩ অক্টোবর রাতে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯’-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নিষিদ্ধ সংগঠনের বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪’, ‘পেনাল কোড ১৮৬০’-এর একাধিক ধারা এবং ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯’-এর অধীনে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার বা জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। ‘এখনও সেই একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করি না। গণতান্ত্রিকভাবে, সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চলুক, আমরা তা চাই,’ মন্তব্য মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনের।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, নাহিদ ইসলামের ওই ঘোষণা আসলে ‘স্পষ্ট হুঁশিয়ারি’। তার ওই ঘোষণাকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেওয়া বিভিন্ন ঘোষণা বা সেই আমলে হওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে তুলনা করতেও দেখা যাচ্ছে। তার ফেসবুক পোস্টে তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কথা লিখেছেন। বলছেন, আওয়ামী লীগ ‘সন্ত্রাসী’ কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি ‘সুশীল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের দিয়ে ফ্যাসিবাদের বয়ান ও বৈধতা তৈরি করে।’ তার মতে, এই দলের ‘কুখ্যাত প্রোপাগান্ডিস্টরা (অপপ্রচারকারীরা) নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নৃশংস খুনি নেতাদের জনপরিসরে হাজির’ করেছে। তারপর এখন সেটিকে ‘নরমালাইজ (স্বাভাবিক) করতে বিভিন্ন মিডিয়া প্লাটফর্ম ও সাংবাদিকরা উদ্যোগ নিচ্ছে।’ এসব করে কোনো লাভ হবে না জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা আরও যোগ করেন, ‘রক্তের উপর দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে। আওয়ামী সিম্পেথাইজাররা এটা যত দ্রুত মেনে নিবে তত মঙ্গল।’

আইনজীবী থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মী কিংবা শিক্ষক, অনেকেই মনে করছেন যে নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অন্তরায়। যে আইনের অধীনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হলো, তার ধারা-৯ অনুযায়ী, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ১৮-এর অধীন কোনো নিষিদ্ধ সত্তাকে সমর্থন করিবার উদ্দেশ্যে কাহাকেও অনুরোধ বা আহ্বান করেন, অথবা নিষিদ্ধ সত্তাকে সমর্থন বা উহার কর্মকাণ্ডকে গতিশীল ও উৎসাহিত করিবার উদ্দেশ্যে কোনো সভা আয়োজন, পরিচালনা বা পরিচালনায় সহায়তা করেন, অথবা বক্তৃতা প্রদান করেন, তাহা হইলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন।’ শুধু তাই নয়, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নিষিদ্ধ সত্তার জন্য সমর্থন চাহিয়া অথবা উহার কর্মকাণ্ডকে সক্রিয় করিবার উদ্দেশ্যে কোনো সভায় বক্তৃতা করেন অথবা রেডিও, টেলিভিশন অথবা কোনও মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনো তথ্য স¤প্রচার করেন, তাহা হইলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন।’

এক্ষেত্রে আরো বলা যায় যে, বেসরকারি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে ২০১৫ সালে তারেক রহমানসহ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম ও দুজন সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছিলো।

এই আইনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার এই আইন দিয়েই বিরোধী দলকে মিছিল-আন্দোলন করতে দিতো না। যদিও সংগঠন নিষিদ্ধ হলেও ব্যক্তি নিষিদ্ধ হতে পারে না, সে যত ঘৃণিত হোক না কেন। তবে কেউ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর এরকম প্রচার করাটা সুপ্রিম কোর্টের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।’

ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ তো করা হয়েছে। এরপর কি তারা আর নিজেদের কার্যক্রম চালাবে না? সে প্রশ্ন নাহয় বিশ্লেষকেরা ভেবে দেখবেন। অতীতের সরকারগুলো অনেক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে কিংবা দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। কেন হয়নি?

এর উত্তর কিন্তু খুব সোজা। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সহিংসতা  ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগের নৃশংস ভ‚মিকা কমবেশি সবারই জানা। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেনি তারা। গণঅভ্যুত্থানের পরপর ‘মব কিলিং’ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটেছে। নানান জায়গায় সহিংসতা হয়েছে। সেই সঙ্গে চাঁদাবাজিও কিন্তু বন্ধ হয়নি। এসব বন্ধ করতে হবে।

ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার আইনি ধারায় সত্তা মানে মূলত সংগঠনকে বোঝানো হয়েছে। ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থার মধ্যে যে অধ্যাদেশ জারি করেছিলো, পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তা ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ হিসাবে সংসদে পাশ হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যে অপকর্ম করে বেড়িয়েছে, সেই অপকর্মের ফল তাদের একদিন না একদিন ভোগ করতেই হতো। তবে এসব এখন অতীত। আর অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ যেন আর কোনো দিনও ফিরে আসতে না পারে, এ জন্য যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হবে, সেটা হচ্ছে অপকর্মকে সব সময় অপকর্ম হিসেবেই দেখতে হবে। কোনো ব্যক্তি কিংবা আদর্শকে পুঁজি করে এই বাংলাদেশে যেন কেউ আর অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইতে না পারে। সূত্র: বিবিসি

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট