মৌলিক রাষ্ট্র্র বলতে সেই রাষ্ট্রগুলোকে নির্দেশ করে যেগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ভ‚মিকা পালন করে। এগুলো সাধারণত শক্তিশালী অর্থনীতি, উন্নত সামরিক দক্ষতা এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থানের অধিকারী হয়। এছাড়াও এ ধরনের রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। বিশ্ববাজারে প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রযুক্তি, উদ্বোধন এবং সামরিক খাতে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে। মৌলিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় বিশ্বব্যাপী সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে থাকে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামোকে গঠন করতে এগিয়ে থাকে।
উল্লেখ করা জরুরি যে, মৌলিক রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতার গুরুত্ব সর্বাধিক। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সভ্যতা ও সময়ভেদের ভিন্নরূপের কারণে মৌলিক রাষ্ট্রের পটপরিবর্তন হয়ে থাকে। সভ্যতা একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, এবং সামাজিক মূল্যবোধকে ধারণ করে। এজন্যই জাপানি সভ্যতাকে একটি মৌলিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও সিনিক, অর্থোডক্স এবং হিন্দুসভ্যতার প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে এক-একটি প্রভাবশালী ‘মৌলিক রাষ্ট্র’ বলে বিবেচনা করা হয়। অপরদিকে, অন্য সভ্যতা দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র যেমন: লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকা কোনো মৌলিক রাষ্ট্র নয়। কারণ, এই রাষ্ট্রগুলো বহুদিন ধরে ইউরোপীয় সাম্রজ্যবাদী শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। যার ফলে এই রাষ্ট্রগুলোর সভ্যতা পূর্ণাঙ্গ নয়। বাংলাদেশ একটি মৌলিক রাষ্ট্র কিনা অথবা ভবিষ্যতে মৌলিক রাষ্ট্র হতে পারবে কিনা এটি বুঝতে হলে বাংলাদেশের সভ্যতা জানা জরুরি।
কেননা সভ্যতা বলে দেয় একটি রাষ্ট্রের শেকড়ের ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাস দীর্ঘ, জটিল এবং ঘটনাবহুল। এই ইতিহাসে উপনিবেশবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের নানা অধ্যায় রয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বাংলাদেশ দখল, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাংলাকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই ভাগে বিভক্ত করা। অতঃপর, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিচ্ছিন্ন অধ্যায় ছিল পূর্ব পাকিস্তান যা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থলাভিষিক্ত হয়। সকল ঘটনা-ই বাংলাদেশের সভ্যতাকে যেমন আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত করছে তেমনি রাজনৈতিক টানাপড়েন ও জাতির কাছে মিথ্যা ইতিহাস তুলে ধরায় সভ্যতাকে করেছে কলুসিত।
অন্যদিকে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সংযোগের কারণে বাংলাদেশের সভ্যতা হয়েছে আরো বেশি জটিল। কেননা ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ই গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তাসহ অনেক আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর নির্ভরশীল। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান এবং নদীগুলোর উজানে থাকার কারণে ভারতের পানি ব্যবস্থাপনা এবং বাঁধ নির্মাণ সরাসরি বাংলাদেশের নদীনির্ভর অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধ বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং পানির প্রাপ্যতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অন্তরায়। সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান, মানব পাচার এবং সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক প্রায়ই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা সংকটের সময়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পায়নি বলে অভিযোগ করা হয়। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকায় ভারত কার্যকারীভাবে এই সংকট সমাধানে উদ্যোগী হয়নি বলে অনেকের অভিমত।
এর ফলে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের চাপ সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের ওপর এসে পড়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে বাংলাদেশকে প্রায়ই ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশের সুবিধার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ভারত যখন বাংলাদেশের ভ‚খণ্ডের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরাম রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেয় তখন এই ধরনের সুবিধা বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলকভাবে কম লাভজনক হয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক জটিল এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে হলেও কিছু ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব এবং নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে শোষণ হিসেবে অনুভ‚ত হয়। এসব পরোক্ষ শোষণ নীতির ফলে সুদূর অতীত থেকে বর্তমানে বাংলাদেশের সভ্যতা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জটিল সমীকরণ সমাধান করার লক্ষ্যে এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব বাজারে একটি মৌলিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। প্রথমত, ভারতের সঙ্গে একটি সুদূর এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি এবং অর্থনীতির দিক থেকে বিশ্বের একটি বৃহৎ বাজার তাই বাংলাদেশের জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর ও বহুমুখী হতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ এবং ভারতকে নিজেদের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য নিশ্চিত করার জন্য চুক্তিগুলো সহজতর করতে হবে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা এবং অগ্রাধিকারমূলক বানিজ্য চুক্তি বাড়ানোর মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এই অঞ্চলের অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের জন্য যৌথ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল, সড়ক এবং জলপথের মাধ্যমে যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এর ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্য, পর্যটন এবং বিনিয়োগ আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে।
এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশকে সত্যি সত্যি একটি মৌলিক রাষ্ট্র করতে হলে অভ্যন্তরীণ সমস্যার দিকেও নজর দিতে হবে। বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে বাংলাদেশেকে একক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির রাষ্ট্র হতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং রাজনৈতিক বিভক্তি একটি সমস্যা। নিবার্চন কেন্দ্রিক সহিংসতা, ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় আসার প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করেছে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। প্রশাসনিক দুর্নীতি, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বার বার নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্ক, কারচুপি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টির ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সমস্যাগুলো সরকারের নীতিমালার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ একটি মৌলিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। তাই এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যদিকে, ভারত ছাড়াও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশেকে শক্তিশালী, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। চীন, মিয়ানমার, নেপাল ও ভ‚টানের সাথে বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, জ্বালানি সহযোগিতা এবং ট্রান্সপোর্ট করিডর উন্নয়নের মাধ্যমে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় শক্তির সাথে সুষম কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এর মতো সংস্থাগুলোর সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত করে তাদের মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি, সুদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি মৌলিক রাষ্ট্র হতে পারবে কিনা সেটা বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কোন দিকে যায় সেটার উপর নির্ভর করছে।
লেখক: শিক্ষার্থী
Comments