বিশ্বরাজনীতি একটি আলোচিত ও গঠনমূলক বিষয়বস্তু। সময়ের সাথে বৈশ্বিক রাজনীতির ধরন ও কলাকৌশলে বেশ পরিবর্তন আসে। যার ছাপ বর্তমানে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। চলমান বিশ্বরাজনীতির ইতিবৃত্ত শুধুমাত্র সমরাস্ত্র, কূটনীতিক সমন্বিত চুক্তি, পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ এসব কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন বেশ প্রভাব ফেলে আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতির কাঠামো ব্যবস্থাপনায়ও।
বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। নির্বাচন শুধুমাত্র দেশের মধ্যে নতুন প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করে না। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই প্রতিনিধিত্বের উপস্থিতির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বৈশ্বিক মোড়লদের সাথে উদীয়মান উঠিত শক্তিধর দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য চুক্তিসহ ক‚টনৈতিক কলাকৌশল বিনির্মাণ এই নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধির স্বভাবসুলভ আচরণ, বৈশ্বিক ভাবনা-চিন্তা, দেশীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতগুলোকে ইতিবাচক গতিশীলতার মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টিতে নির্বাচন আকষর্ণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে দেশে ও বর্হিবিশ্বে।
ঠিক তেমনি একটি নির্বাচন ব্যবস্থা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যা বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। আলোচনা-সমালোচনার সাথে কূটনৈতিক মারপ্যাঁচের হিসেব নিকাশে জড়িত থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক মোড়লদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। চার বছর মেয়াদি এই নির্বাচন নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৪৮ সাল থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবারে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই নির্বাচন। এবারের মার্কিন নির্বাচন নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার বা ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের মোট আসন সংখ্যা ৫৩৮টি। এই নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হয়। ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোটের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ করে নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে বিজয়ী হন ট্রাম্প।
এতেই সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙে এক মেয়াদের বিরতিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাজকীয়ভাবে হোয়াইট হাউসের মসনদে ফিরলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে অতীতে মাত্র একবারই একজন প্রেসিডেন্ট ভোটে পরাজিত হয়েও পরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসের মসনদে ফিরেছিলেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার ২২তম এবং ২৪তম রাষ্ট্রপতি স্টিফেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-লেবানন-ইসরাইল যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সংকট, তাইওয়ান সংকট এবং কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে এবারের মর্কিন নির্বাচনে বিশ্ববাসীর চোখ ছিল। নির্বাচনী প্রচারে কমলা ও ট্রাম্প অভ্যন্তরীণ নীতির পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন। বিশেষ করে দুজনের পররাষ্ট্রনীতির ওপর বহির্বিশ্বের বাড়তি আগ্রহ ছিল। বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সকল দেশের সাথে কোনো না কোনো প্রভাব বিস্তারকারী ভ‚মিকা রাখেন। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা, নীতি, মনোভাব এবং সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলে। তাই বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় এই নির্বাচনের কদর অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেবলমাত্র আমেরিকানদের নয়, বিশ্বজুড়ে সকল মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা একটি চরিত্র। অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে বৈশ্বিক রাজনীতির যেকোনো মোড় ঘোরানো সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকেন তিনি। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে বর্ণিত করা হয় না। তাকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তার অতি গুরুত্বতার জন্য তাকে আন্তর্জাতিক চরিত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনে বিশ্বরাজনীতির মোড় কোন দিকে যায় সেদিকে এখন সবার নজর। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচনে জয়ী হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা করা কমিয়ে দিবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ৬১ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিরাপত্তাসহায়তা দিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এ সময় ইউক্রেনে যুদ্ধ সম্প্রসারণ না করতে পুতিনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার মধ্য দিয়ে বছর তিনেক ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের রাশ টানার সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদ দেখা দিয়েছে। কেননা, দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে ট্রাম্প।
২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীনের সাথে সরাসরি বাণিজ্য যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, উত্তর কোরিয়ার সাথে বিরোধ পাশাপাশি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হওয়াসহ কঠোর অভিবাসন নীতি বেশ উল্লেখযোগ্য ছিল তার শাসনামলে।
হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী চার বছর সামলাবেন বিশ্বরাজনীতির ময়দান। তার উপরই নির্ভর করছে আগামী চার বছরের বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির ময়দানের সকল প্রকার মারপ্যাঁচ। আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতির মোড় কোন দিকে ঘুরে যায় সেসব কৌশলগত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ক্ষমতা প্রদর্শনীর বেষ্টনীর দেখা মিলবে আগামী চার বছরে। বিশ্ববাসী আশা করছে ইতিবাচক ও সুশৃঙ্খল বৈশ্বিক ভ‚রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার। যার সুফলে সকল প্রকার যুদ্ধ বন্ধের মাধ্যমে শান্তির মশাল জ্বলবে বিশ্বজুড়ে।
লেখক: শিক্ষার্থী
Comments