Image description

পাকিস্তানের সীমাহীন লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিপরীতে সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জড়িয়ে গেছে বিহারিদের নাম। অবশ্যই সেটা নেতিবাচকভাবে। ভারতের বিহার রাজ্যের অধিবাসীরাই বিহারি নামে পরিচিত। ধর্মে মুসলমান হওয়ার কারণে জাতিগতভাবে এরা ঝুঁকে পড়ে পাকিস্তানের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই বিহারি জনগোষ্ঠীর বসবাস বাংলাদেশে। ব্রিটিশ আমলে তাদের আনুকূল্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে সৈয়দপুরে রেল কোম্পানিতে যোগদান করতে প্রায় সাত হাজার অধিবাসী আসে বিহার থেকে। সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলে এ দেশ থেকে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতে চলে যায়। অন্যদিকে প্রায় সমসংখ্যক মুসলমান চলে আসে পাকিস্তানে।

বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে বসবাস করলেও এ বিহারিরা বাংলাকে ঠিক মেনে নিতে পারেনি। বাঙালিরাও এদের মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে একটা দূরত্ব ঠিকই থেকে গিয়েছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে বিহারিরা যে নেতিবাচক ভ‚মিকা রেখেছিল তা ‘জঘন্য প্রতিবেশী’সুলভও নয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নীলফামারী, ময়মনসিংহসহ আরও কয়েকটি জায়গায় বিহারিরা প্রকাশ্যে বাংলাবিরোধী অবস্থান নেয়। একাত্তরের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে পাকিস্তানি শাসকদের বিরূপ আচরণে শোক-প্রতিবাদের কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হতো অনেক বাড়িতে। বিহারিরা এ পতাকাগুলো নামিয়ে পুড়িয়েছে বিকৃত উল্লাসে। সেখানেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বিপরীতে উড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি পতাকা! বিহারিদের বিতর্কিত ভ‚মিকা আরও ব্যাপক। ব্যাপক হারে বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে তারা। যা ধরা পড়েছে শহীদজননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’সহ অনেকের রচনায়, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে। সে সময়ে গণহারে বাঙালি হত্যা, বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুট করেছে এরা।

২৫ মার্চের কালরাতে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাণ্ডবে যোগ দিয়েছিল বিহারিরাও। ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণ বিসর্জন, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিসহ হাজারও প্রতিক‚লতা মোকাবিলা করে একসময় বাংলাদেশ ঠিকই স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে আটকা পড়ে বিহারিরা। তারা আর ফিরে যেতে পারেনি, পাকিস্তানি শাসকরাও ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেনি। জানা যায়, স্বাধীনতার সময় বিহারিরা যেভাবে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, দেশ স্বাধীনের পর বাঙালিদের কেউ কেউ হয়ে উঠেছিলেন প্রতিশোধপরায়ণ। অবশ্য অধিকাংশ বাঙালিই ‘পরাজিত’ বিহারিদের ক্ষমা করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর দেশে টালমাটাল পরিস্থিতিতে এদের নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাবার অবকাশও ছিল না। রাজনৈতিক কারণেই পাকিস্তানি শাসকরা বিহারিদের বাংলায় এনেছিল, আদর্শগত কারণে তারা পাকিস্তানেরই নাগরিক। শেষ বিচারে বিহারিদের অবস্থা হয়ে পড়ে ত্রিশঙ্কু।

ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ- কোনো দেশেরই ‘নাগরিক’ হয়ে উঠতে পারেনি তারা। দাঁড়াতে পারেনি স্বতন্ত্র কোনো বৈশিষ্ট্যে। স্বাধীনতার পর কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হয়। নাগরিকত্ব প্রশ্নে বিহারিরা পাকিস্তানের পক্ষে মত দিলে তাদের ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ অভিধা দেয়া হয়। একাংশকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। বাকিরা থেকে যায় ক্যাম্পে। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে এ ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’দের কয়েক পরিবারকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ২০০৮ সালে হাইকোর্টে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে দেয়া রায়ে আটকে পড়া প্রায় ৫ লাখ পাকিস্তানিকে বাংলাদেশের নাগরিক ঘোষণা করা হয়। এর বিপরীতে আপিল করে সরকার। তারপর কয়েক হাজার বিহারিকে জাতীয় পরিচয়পত্রও সরবরাহ করা হয়। এরা এখন ভোটাধিকারপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক। বিহারিদের মানবেতর জীবনযাপন দেখা যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী-খুলশী এলাকাধীন ওয়্যার্লেস-ঝাউতলায় রয়েছে বিপুলসংখ্যক বিহারির বসবাস। বড় একটি বিল্ডিংয়ে কয়েক হাজার মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। এদের একাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। প্রায় অভিন্ন অবস্থা ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পেও। 

বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিহারিরা বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করলেও নিজেদের ভাষাতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পেশাগত জীবনেও তারা পিছিয়ে। বিহারিদের সংগঠনও রয়েছে। মাঝে-মধ্যেই তারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানায়। বাংলাদেশের সহানুভূতিশীল সাধারণ মানুষ এদের দাবি পূরণে ভূমিকা রাখতে না পারলেও কখনো বিরূপ আচরণ করেনি। বিহারিদের কৃত অপরাধও ক্ষমা করে দিয়েছে জাতিগত উদারতায়। অবাক বিষয় হচ্ছে- এখন পর্যন্ত কোনো বিহারি কিংবা সংগঠন ক্ষমা চায়নি! স্বীকার করেনি, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল না। এমনতর নীরবতা যেমন তাদের নৈতিক সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। উত্তরপুরুষদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না। বরং মানুষ হিসেবে তারই মর্যাদা বাড়ে, পরিষ্কার হয় নৈতিক অবস্থান। যদি উল্টোটাই সত্য হয়- নেতিবাচক আদর্শের (!) ধারক-বাহক হয় পরবর্তী প্রজন্ম তাও কম লজ্জার নয়। এ নষ্টবীজ তারা বহন করে চলে, চলমান থাকে ভ্রান্ত মতাদর্শ।

কোনো কোনো বিহারি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বলেও জানা যায়। যদিও সংখ্যায় তা খুবই কম। একাত্তরে বাংলাদেশের বিপক্ষে কাজ করেছিল ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী ও বিহারিরা। এ বিহারিদের সঙ্গে জামায়াতিদের সংশ্লেষ না থাকলেও মূল জায়গায় তাদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ‘বিরোধিতা’র মাশুল নানাভাবে দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। চট্টগ্রামের ওয়্যার্লেস গেট, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প কিংবা নারায়ণগঞ্জের আদমজী- সবখানেই বিহারিদের কোণঠাসা অবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে এরা অনেক পিছিয়ে। পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠী শত সমস্যা মোকাবিলা করেও শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হচ্ছে। সমাজে জায়গা করে নিচ্ছে। সেখানে বিহারিদের পড়াশোনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না থাকাটা বিস্ময়কর। দারিদ্র্যের সঙ্গে অশিক্ষার ওতপ্রোত একটি যোগ রয়েছে। দরিদ্র মানুষের পক্ষে শিক্ষা গ্রহণ কঠিন। তাই বলে বোধহয় এতটা নয়! বিহারিদের এ পিছিয়ে থাকার পেছনে হয়তো অনাগ্রহই কাজ করছে। 

এ সমস্যার বিহিত হওয়া অবশ্যই দরকার। বিহারিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে থাকবে, নাকি বাংলাদেশিদের মতোই সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে অথবা সমঝোতার মাধ্যমে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হবে স্বদেশে। অবশ্য পাঠানোর প্রক্রিয়াটি মোটেও সহজ নয়। কৃত অপরাধের জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চাওয়া দূরে থাকুক, কখনো অপরাধ স্বীকারই করেনি। সেখানে তারা বিহারিদের তারা ফিরিয়ে নিতে চাইবে না- এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা চালালে উল্টো এটাকে বানিয়ে ফেলতে পারে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের একটি ইস্যু! যেভাবে নিকট অতীতে তারা একের পর এক ক‚টনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছে। ২৫ মার্চ গণহত্যার বিষয়টি আগ থেকেই জানতো বিহারিরা। অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের লেখায় উঠে এসেছে বিষয়টি। তিনি থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসনের ২৪ নম্বর বাড়িতে। তাদের বাড়ির নিচে একজন অবাঙালি অধ্যাপক বসবাস করতেন। ২৫ মার্চের আগেই সেই শিক্ষক কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এটা থেকেই ধারণা করা যায়, কালরাতের ঘটনা বিহারিরা জানত আগ থেকেই। অন্তত তাদের জানানো হয়েছিল। নেপথ্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ইন্ধন ছিল কিনা সে বিষয়ে জোরালো কোনো সাক্ষ্য নেই।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখায়ও ধরা পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিহারিদের দ্বিমুখী চিত্র। ১৯৭১-এ স্বাধীন দেশের ‘প্রথম প্রহরের’ কথা উঠে এসেছে ‘কত না অশ্রুজল’ রচনায়- ‘...জিগাতলা বাজারের গলির ভেতর দিয়ে আসছি, হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলো। আটকেপড়া বিহারিরা গুলি ছুড়ছে। গলি দিয়ে লোক চলাচল বন্ধ। আনিস ভাই (আনিস সাবেত) বললেন, আজ আমাদের পায়ে গুলি লাগবে না, চলো যাই। সেদিন গোলাগুলির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম, নাকি গুলি থামার জন্য অপেক্ষা করেছি, তা আর মনে করতে পারছি না। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে দুজন থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তা এবং ফুটপাতে একটি পুরো পরিবারের মৃতদেহ। এরা বিহারি। ছোট শিশু আছে। একটি কিশোরীও আছে। কিশোরীর মুখশ্রী কত না সুন্দর! আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড হাহাকার তৈরি হলো। সেই হাহাকারে কিছুটা আমি এখনও বহন করি...।’ 

পাশাপাশি দুটি চিত্রই অস্বাভাবিক। একদিকে স্বাধীন দেশে বিহারিদের গোলাগুলি যেমন অস্বাভাবিক অন্যদিকে বিহারি পরিবারের মৃত্যুও বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লেখক এর নেপথ্য কারণ জানাতে পারেননি অথবা এড়িয়ে গেছেন, তবে প্রকৃত অবস্থা বুঝে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কী হবে বাংলাদেশে থাকা বিহারিদের! যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্তে আসা জরুরি। নইলে সমস্যাটি জিইয়ে থাকবে, পুঞ্জীভূত হবে অসন্তোষ। পিছিয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য কতটুকু ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা ধারণ করে, ভবিষ্যতে কোন দিকে মোড় নেবে এসব প্রশ্নসাপেক্ষ। সমস্যাটা জিইয়ে রাখা অবশ্যই অস্বস্তিকর।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও রম্যকার