‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সব সময় ট্রাম কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে’
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয় নিয়ে দৈনিক মানবকণ্ঠে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি সুস্মিতা কর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মানবকণ্ঠের সহ সম্পাদক সনজিৎ সরকার উজ্জ্বল।
প্রশ্ন-১: যা রটে তার কিছু না কিছু ঘটে! ৫ আগস্টের পূর্বেও এদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত হেনেছে আর ৫ আগস্টের পরেও যে এমন আঘাত আসেনি তা অস্বীকার করার অবকাশ নাই। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় এক হিন্দু যুবকের কোরআন অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি, দোকানপাট ও স্থানীয় লোকনাথ মন্দির ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটে। বিগত সময়েও এমন ঘটনা ঘটেছিল। দেশের প্রচলিত আইনে এসব ঘটনার যথাযথ বিচার সুসম্পন্নের কোন নজির কী আছে?
সুস্মিতা কর: যথাযথ বিচার পাওয়ার বিষয়টা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। আমরা অনেক সময় শুনি আইন নাকি অন্ধ ; এক প্রকার উপহাস করেই বলতে হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেলাতে আইন বা বিচার ব্যবস্থা সত্যিই অন্ধ! বিগত ৫৩ বছরেই যথাযথ বিচার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পায় নি বললেই চলে ; বিভিন্ন সময় এসব ঘটনার মামলাও নেওয়া হয় না। আবার অনেক সময় পাগল বা নাবালককে আসামি হতে দেখেছি।
প্রশ্ন-২: অনেক সময় মামলা হলেও এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার কেন বিলম্বিত হচ্ছে? দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে আসলে অসুবিধাটা কোথায়?
সুস্মিতা কর: সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি ধর্ম নিরপেক্ষতা ; দ্বিতীয় ভাগের ১২ (গ) তে বলা আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার করা যাবে না ; কিন্তু বিভিন্ন সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ট্রাম কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলির পাঁঠা হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় । যতক্ষণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা আসবে না ততক্ষণ এটা নিয়ে আলোচনা হবে ; বিভিন্নভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সিমপ্যাথি দেখানো হবে । কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পর বা বড় কোনো ইস্যু মোটামুটি ধামাচাপা দেওয়ার পর নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের কথা কারো মনে থাকে না, এটাই বাস্তবতা।
প্রশ্ন-৩: নড়াইলে এক নারী ইউপি সদস্যকে (৪৬) সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও মুখে বিষ ঢেলে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। টিসিবির মালামাল দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাজিবুল নামে একজন তাকে ফোন দিয়ে পাওনা টাকা নিতে ডাকে। সেখানে যাওয়ার পর রাজিবুলসহ কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করে। পরে তারা দুই লাখ দাবি করে। ইউপি সদস্য লোকজনকে বিষয়টি জানাবে বললে তাকে হুমকি-ধমকি এবং মুখে বিষ ঢেলে দেয়। বাড়ি ফিরে তিনি ভয়ে কাউকে কিছু বলেননি। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় মৃত্যুর আগে ছেলের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা ও জড়িতদের নাম বলে যান। এবার প্রশ্ন হলো কেবলমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কী এমন পাশবিক ঘটনা ঘটলো নাকি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে এমনটি হলো।
সুস্মিতা কর: সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে যদি নির্যাতন হয়ে থাকে এইটা কি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নয় ? সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের নীতি এবং আদর্শের দিকটা তুলে ধরে ; সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তো মানুষ , যে কারণেই তাদের উপর হামলা হোক তা অবশ্যই নিঃসন্দেহে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কে নির্দেশ করবেই । কোনো সুস্থ মানসিকতার (নীতিবান ও আদর্শ) ব্যক্তির পক্ষে কোনো মানুষের ওপরই হামলা করাটা সম্ভব না । আর যদি সংখ্যালঘু হবার কারণেই এসব হয় সেক্ষেত্রে এমনটাও হতে পারে , আমরা ধর্মটা ধারণ করতে পারছি না হয়তো ; কারণ কোনো ধর্মই অন্যায় সমর্থন করে বলে আমি মনে করি না । আমরা অন্যের ধর্মকে ছোট করার থেকে যদি নিজের ধর্ম চর্চা বা ধর্মীয় আদর্শ ধারণে ফোকাস করতাম তাহলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত অনেকটাই কমে আসতো।
প্রশ্ন-৪: তাহলে কী আমরা আশঙ্কা করতে পারি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ইউপি সদস্যরাও এই নরপিশাচদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে ?
সুস্মিত কর: একদম , যারা সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসেবে বিবেচিত করা উচিত। আজকে যারা ধর্মের নামে একটা গোষ্ঠীর শোষণ করছে , তারা স্বার্থে আঘাত লাগলে যে কাউকে আঘাত করতে পারে ; যে খুনি সে যদি একজন সংখ্যালঘুকে হত্যা করে সে কিন্তু একজন মানুষকেই হত্যা করছে , তাদের মধ্যে তো মানবিকতাবোধই কাজ করছে না , তাদের কাছে ধর্ম-বয়স-লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে কেউই নিরাপদ না ।
প্রশ্ন-৫: সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের ৮ দফা দাবি আন্দোলন কী থেমে গেল?
সুস্মিতা কর: "সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন" কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না । হিন্দু - বৌদ্ধ - খ্রিস্টান - আদিবাসী সকলের বিষয়েই আমরা ভাবছি , কাজ করার চেষ্টা করছি । যতটুকু আমি জানি , সনাতনী জাগরণ জোট বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনকে একত্রিত করে হয়তোবা গঠিত হয়েছে , সেক্ষেত্রে সাংগঠনিক নেতৃবৃন্দ কি ভাবছেন এ বিষয়ে আমি বলতে পারছি না । তবে ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থী সমাজ থেকে যে ৮ দফা দাবি পেশ করা হয় তা সম্পূর্ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের । তাই ৮ দফা নিয়ে কর্মসূচি চলমান থাকবে।
প্রশ্ন-৬: বর্তমানে গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার কথা শুনা যাচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী বলছে।
সুস্মিতা কর: বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমকেই সরকারের মাধ্যম নাম দেওয়া উচিত। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে গণমাধ্যম তাদের লিয়াজু মেইনটেইন করতে পছন্দ করে। আমি দেখেছি আমারই বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য টুইস্ট করে পাবলিশ হয়েছে , এতে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক ঘটনা পৌঁছায় না। সংখ্যালঘু সর্বোপরি এ দেশের গণমানুষের অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন-৭: উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ও জনাব সুপ্রদীপ চাকমা তাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনে সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন কিনা।
সুস্মিতা কর: তাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হয়তো তাঁরা ভালোভাবে পালন করছেন ; কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পার্ট হবার পরেও এসকল বিষয়ে চুপ থেকে ওনারা সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গাটা হারাচ্ছেন । জনাব বিধান রঞ্জন রায় তো এখন পর্যন্ত আমাদের অধিকারের বিষয়ে কোনো বক্তব্যই রাখেন নি। আশা করেছিলাম উনি হয়তো সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সজাগ থাকবেন কিন্তু আমরা হতাশ উনার নীরব ভূমিকায়।
প্রশ্ন-৮: সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে হিন্দু সেজে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৮ নারীসহ আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি-উত্তর)। হিন্দু সেজে ডাকাতি করতে যাওয়ার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করছেন?
সুস্মিতা কর: সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার জন্য এমনটা করে থাকতে পারে । হিন্দুদের আরো কোণঠাসা করে রাখা , তাদের হয়তো ভুমি দস্যু বা জঙ্গি হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে চাইছে একটা মহল ; সবটাই আমাদের অনুমান , সত্য ঘটনা বা কারণ তুলে ধরার দায়িত্ব তো প্রশাসনের।
Comments