Image description

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। সরকারের এই পদক্ষেপটি দেশের সাধারণ জনগণের ওপর, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দৈনন্দিন খরচে।

খাদ্যসামগ্রী, পোশাক, চিকিৎসাসেবা, মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা, এবং অন্যান্য প্রাত্যহিক ব্যবহারের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর ফলে মধ্যবিত্তদের জন্য একটি বড় আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে, কারণ তাদের আয়ের তুলনায় খরচ বেড়ে যাবে। ফলে, তাদের সঞ্চয় কমে যাবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন আসবে। অতিরিক্ত বিলাসিতামূলক খরচ যেমন রেস্তোরাঁয় খাওয়া বা বিনোদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে। এর পাশাপাশি, ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্য ও সেবার চাহিদা কমে যেতে পারে, যা বাজারে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

সরকারের দাবি অনুযায়ী, দেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত অত্যন্ত কম। বর্তমানে এটি মাত্র ৭.৫ শতাংশের কাছাকাছি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে এটি ১২ শতাংশ এবং নেপালে ১৫ শতাংশের বেশি। সরকার মনে করে, রাজস্ব বাড়িয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হলে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ তাদের আয়ের বড় অংশই ভ্যাটযুক্ত পণ্য ও সেবার পেছনে ব্যয় হয়। ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ী, ভোক্তা সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। 

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা সরাসরি ভোক্তাদের ওপর চাপ তৈরি করবে। এতে পণ্যের চাহিদা কমে গিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে। অনেক ব্যবসায়ী আশঙ্কা করছেন যে, ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে, ফলে বাজারে মন্দাভাব দেখা দেবে। ভোক্তা সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এই সিদ্ধান্তের কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ তাদের জীবনযাত্রার মানকে আরও কঠিন করে তুলবে। প্রথমত, খাদ্য, পোশাক, জ্বালানি, শিক্ষা এবং চিকিৎসা খাতেও ভ্যাট বৃদ্ধি পাবে। 

এর ফলে, বাজারে খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাবে, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খরচের চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে, রুটি, সবজি, মাংস, ডিম ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যগুলোর দাম বাড়লে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। এছাড়া, পোশাকের দামেও বাড়তি চাপ পড়বে, কারণ পোশাক শিল্পেও ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। সাধারণভাবে, মধ্যবিত্তরা সাশ্রয়ী মূল্যে পোশাক কেনার চেষ্টা করে, কিন্তু ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে তাদের পোশাক কেনার খরচ বেড়ে যাবে, যা তাদের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জ্বালানি খাতের ওপরও এই ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। 

গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ পরিবারের মাসিক বিলের পরিমাণ আরও বাড়বে, যা তাদের আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে। বিশেষত, গরম এবং শীতকালে গ্যাস এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে ভোক্তা খরচে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হবে। মোবাইল বিল ও ইন্টারনেট সেবার দামও বেড়ে যাবে, যার ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির খরচ বেড়ে যাবে। রেস্তোরাঁতে খাওয়ার খরচও বাড়বে, কারণ খাওয়ার বিলের ওপর বাড়তি ভ্যাট চাপানো হয়েছে, যা মধ্যবিত্তদের জন্য বিলাসিতা কমিয়ে দিতে বাধ্য করবে।

সাধারণ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর প্রভাব না ফেলে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সরকার বিকল্প কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রথমত, বিলাসদ্রব্য এবং উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের ওপর কর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। দামি গাড়ি, ব্র্যান্ডেড পোশাক, এবং বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ ও হোটেলের মতো খাতে অতিরিক্ত কর আরোপ করলে মধ্যবিত্তের জীবনে প্রভাব ফেলবে না। দ্বিতীয়ত, অব্যবহৃত জমি বা বড় সম্পদের ওপর কর আরোপ করা হলে রাজস্ব বৃদ্ধি সম্ভব। এ ছাড়া, প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। বাংলাদেশের কয়লা, গ্যাস, এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বাড়িয়ে তা রপ্তানি করলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাবে। 

তৃতীয়ত, রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ বিশেষত তৈরি পোশাক, চামড়া, আইটি, ওষুধ শিল্প, এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি সম্ভব। এ খাতগুলোর উন্নয়ন মধ্যবিত্তের ওপর চাপ তৈরি না করে দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। পর্যটন খাতেও রাজস্ব বৃদ্ধির বড় সুযোগ রয়েছে। দেশের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। ই-কমার্স এবং ফ্রিল্যান্সিং খাতের ওপর নামমাত্র হারে কর আরোপ করা যেতে পারে। এই খাতগুলো তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান তৈরি করছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস হিসেবে কাজ করছে। সর্বোপরি, কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং কর ফাঁকি রোধের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব। বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর কাঠামো পুনর্বিন্যাস এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।

সরকার যদি উপরোক্ত খাতগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়, তবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে, অথচ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়বে না। এটি একটি টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভিত্তি হতে পারে। সুতরাং, ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার যদি বিকল্প পদ্ধতিতে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে এটি দেশের মানুষের জন্য অধিক সহনীয় হবে। ভ্যাট বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় অর্থনীতির উন্নয়ন করতে পারে, তবে এর সঙ্গে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করার দায়িত্বও সরকারের। সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে এবং একটি টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী