Image description

সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সহিংসতার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ই মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। ভীষণ অস্থির একটা সময় কেটেছে সবার। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বেশি। অসংখ্য শিক্ষার্থী টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও সেসবের কষ্টকর প্রতিক্রিয়া, গোলাগুলি, আক্রান্তদের আর্তনাদ এসব খুব কাছ থেকে দেখেছেন, শুনেছেন, যার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে তাদের মনে। 

অর্থাৎ এক ধরনের ট্রমায় ভুগছেন তারা। প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন না যেসব শিক্ষার্থী, তারাও টেলিভিশনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মারমুখী সংঘর্ষ, আন্দোলনকারীদের আহত-নিহত হওয়া বা নৃশংসতার ঘটনার ভিডিও দেখে, সহপাঠীদের কাছ থেকে শুনে  আতঙ্ক, ভয়, বিষণ্ণতা, আবেগ প্রকাশে অক্ষমতা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, ভুলে যাওয়া এ ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড এ্যাডোলেসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইক্রিয়াটিক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে-আরো কিছুদিন পর এই ট্রমার বীভৎসতা, নৃশংসতা, এগুলো যখন তাদের স্মৃতিতে চলে আসবে, তখন তাদের ভেতর পিটিএসডি বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে, যা খুবই উদ্বেগজনক। 

অন্যদিকে সরকার পতনের পর আরেকটি ট্রমা সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে বেশ কিছু জায়গায় শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করায়, কেউ পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের লাঞ্ছিত হতে দেখে, শিক্ষকদের জুতার মালা পরানো, চেয়ার থেকে জোর করে উঠিয়ে নির্যাতন করা ইত্যাদি ঘটনা দেখে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় জড়িত শিক্ষকরা আত্মমর্যাদার জায়গা থেকে অপমাণের গ্লানি বহন করছেন, যা তাদের মধ্যে তীব্র বিষণ্ণতা বা ট্রমা তৈরি করেছে। 

এ বিষয়ে গত ২৫ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধি অনুযায়ী শিক্ষকদের নিয়োগ ও বদলি করা হয়। তাদের বলপূর্বক পদত্যাগ করানোর সুযোগ নেই। তাদের কারো বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি- শিক্ষা উপদেষ্টার এই নির্দেশনার আগেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বল প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। একই সূত্রে আরো বলা হয়েছে- সারাদেশে শতাধিক প্রতিষ্ঠানে প্রধান ও শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করাসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে সুযোগসন্ধানী দৃর্বৃত্তরা। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অজান্তে তাদের দ্বারা ব্যবহৃতও হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরি বলেছেন, শিক্ষককে হেনস্তা করা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। 

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলামও বলেছেন, শিক্ষকদের সবাই অপরাধী নয়। অপরাধীর বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়াও শিক্ষার্থীদের কাজ নয়। তবু তারা প্ররোচিত হয়ে বা অন্য যে কারণেই হোক, অনাকাক্সিক্ষত কাজগুলো করে ফেলেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাদেরও এসব কাজে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা শিক্ষকের মর্যাদাকে কলঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট। পাশাপাশি এ কথাও অনস্বীকার্য যে- এসব নিন্দনীয় ঘটনাগুলো ঘটেছে বিপ্লবোত্তর আইন-শৃঙ্খলার অবনতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আইন হাতে তুলে নেয়া বা এসব অপকর্ম থেকে দুর্বৃত্তদের নির্বৃত করার মতো আইনানুগ শাসনদণ্ড দেশের কোথাও ছিল না। এ এক ধরনের দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা যেমন, তেমনি একে রাতারাতি মেনে নেয়াও খুব কঠিন। 

শিক্ষকরা ক্লাসে কীভাবে শিক্ষকসুলভ মনোভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন, শিক্ষাদান করতে গিয়ে কোন কথাতে তারা শিক্ষার্থীদের বিরাগভাজন হবেন, সেই আতঙ্ক বা ভীতিই এখন বেশিরভাগ শিক্ষকের মনে কাজ করছে। ফলে তারা শিক্ষকতার স্বাভাবিক মর্যাদাবোধ,  আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের এই ট্রমা ক্লাসে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষাজীবন। কাজেই, এই ট্রমা থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়কে বের করে আনাটাই এখন ভীষণ জরুরি। বিষয়টিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যাতে  ট্রমা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, সেজন্য তাদের কাউন্সিলিং করাসহ প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে। 

ইতোমধ্যে স্কুল-কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরা অনেকেরই পরিবারের সদস্য, সহপাঠী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। মনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন এর কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী। এই ক্ষত নিয়েই তাদের ফিরতে হচ্ছে পড়ার টেবিলে বা শিক্ষাঙ্গনে। এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে মা বাবা বা অভিভাবকদের পাশাপাশি মনোবল না হারানো শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এই মানসিক ট্রমা থেকে বের করে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। যেমন- ট্রমার ভেতরে থাকা শিক্ষার্থীদেরকে কোনো ভয়ভীতি বা ফলাফল নিয়ে টার্গেট দেয়া যাবে না। এমন কথা বলা যাবে না যে- স্কুল অনেকদিন বন্ধ ছিল, বেশি করে পড়তে হবে বা জিপিএ-৫ পেতেই হবে। ধীরে ধীরে তাদের হতাশা কাটিয়ে দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। দিতে হবে মানসিক চাপ মোকাবিলা ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার কৌশলজ্ঞান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে খানিকটা এড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হবে, আড্ডা দিতে হবে, প্রকৃতির কাছে যেতে হবে। 

এই আন্দোলনে এমন অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, বধির হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, চোখে ছররা গুলি লেগে অন্ধত্ব বরণ করতে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেরই খোঁজ আমরা জানি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে তথ্য নিয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাদের পাশে সহমর্মিতা ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর শিক্ষকদের ট্রমা থেকে মুক্ত করার জন্য স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক সমিতি, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারেন। তারা জেলায় জেলায় শিক্ষক সমাবেশের আয়োজন করে ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার প্রেক্ষিত বিবেচনা ও প্রতিকারের বিষয় তুলে ধরে ট্রমায় আক্রান্ত শিক্ষকদের মনে শিক্ষকের মর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারেন। 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ট্রমা থেকে মুক্ত করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি দু’তরফ থেকেই শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের  সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই ট্রমার বিষণ্ণতা দ্রুতই কেটে যাবে- এমন প্রত্যাশা করা নিশ্চয়ই অমূলক নয়। 

লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই