ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শপথ নিয়ে তিন মাস সময় পার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে সংস্কার। দৃশ্যমান কোনো চিত্র না দেখা গেলেও কিছু অর্জন অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে প্রত্যাশার চেয়ে কম। দখল-আধিপত্য-চাঁদাবাজির সংস্কৃতি এখনো বহাল রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে দখল-আধিপত্য-চাঁদাবাজি হতো- এখন ভাঙানো হচ্ছে অন্য নাম। এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিলেও এমন অপরাধ কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না, শুধু হাতবদল হয়েছে। নেপথ্যে থেকে তো বটেই, প্রকাশ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী পরিচয়ে দখল-আধিপত্য-চাঁদাবাজি চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ইতিবাচক অর্জন থাকলেও তা প্রত্যাশার চেয়ে কম বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, আইনশৃঙ্খলা অবনতির পাশাপাশি দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি থেকে এখনও বের হওয়া যায়নি। পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ, দলীয়করণের বদলে আরেক দলীয়করণে প্রতিস্থাপন, ঢালাওভাবে শত শত মামলায় অসংখ্য ব্যক্তিকে আসামি করা, গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের মতো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চলমান।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনায় টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাগুলোর বিষয়ে গণমাধ্যমসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত ও বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনকে ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের মতো ঘটনা ঘটে গেলেও এসব অপরাধীর দৌরাত্ম্যের অবসান হয়নি। এতে করে দেশের মানুষ ভীষণ উদ্বিগ্ন। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন। পটপরিবর্তনে সঙ্গতকারণেই প্রত্যাশা ছিল- এবার আধিপত্য-চাঁদাবাজি-দখলবাজির অবসান ঘটবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং দেশজুড়ে হঠাৎ করেই শুরু হয় বিভিন্ন পর্যায়ে নানারকম অপরাধ। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছাড়াও অনেক সংগঠন ও গোষ্ঠীর ব্যানারেও বিভিন্ন কৌশলে এহেন অপকর্ম শুরু হয়। শুধু তাই নয়- চাঁদা না দিলে শিল্প-কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ধাক্কায় কেবল চেহারায় বদল ঘটেছে, অপরাধীর দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়নি। আগের মতোই সারা দেশে তাদের উপদ্রব দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- নতুন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও কী করে এমন দৌরাত্ম্য চলছে? সরকার বদলের শুরুর দিকে কিছুটা বিরতি দিয়ে নতুন পরিচয়ে আবার মাঠে নেমেছে অপরাধীরা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেই সরকারের পতনের পর নির্যাতিতরা ভেবেছিল তাদের ভাগ্যে বোধ হয় পরিবর্তন আসবে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা ঘটেনি। প্রশ্ন হচ্ছে- প্রশাসন, বিশেষত পুলিশ প্রশাসন কী করছে? রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অনেক দিন পার হয়েছে। অপরাধীদের অরাজকতার দায় অবশ্যই প্রশাসন, তথা সরকারকেই নিতে হবে। আমরা মুখে বলছি নতুন বাংলাদেশ অথচ সমাজের খারাপ নিয়মগুলো বহাল তবিয়তেই থেকে যাচ্ছে। এভাবে চললে- ‘যে লাউ সেই কদু’তেই পরিণত হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য- অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা দুষ্কর্মের দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি দৃশ্যমান করা যায়নি বলেই অপশক্তির ছায়া এখনও জিইয়ে আছে। আমরা মনে করি- দেশের নানামুখী সংস্কারের তালিকায় পরিবহন খাতও যেন গুরুত্ব পায়। সমাজে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নির্মূল করতে হবে। অবিলম্বে আধিপত্য-দখল-চাঁদাবাজি থেকে মানুষ মুক্তি চান। সর্বোপরি তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই নিতে হবে।
Comments