Image description

বিগত সরকার অর্থ পাচারকে নিয়মিত কাজে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের অনিয়ম-দুঃশাসনের চিত্র জনগণকে ক্রমেই হতাশ করে। দেশ থেকে নানাভাবে অর্থ পাচারের ঘটনা বহুল আলোচিত। মূলত পাচারকৃত অর্থের বড় অংশই যায় বাণিজ্যের আড়ালে। জানা যায়-শেখ হাসিনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিজাত শ্রেণি, ঘনিষ্ঠ ও রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশ থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার চুরি করে টরন্টোর কুখ্যাত ‘বেগম পাড়া’য় সম্পদ কেনাসহ কানাডায় পাচার করেছে। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্য এবং ১০ শিল্প গোষ্ঠীর ‘পাচার করা’ অর্থ ফেরত আনতে একসঙ্গে কাজ করবে রাষ্ট্রের তিন সংস্থা। দুদককে মূল ভ‚মিকায় রেখে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর যৌথভাবে এ কাজ করবে। তাদের কাজ সমন্বয় করবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। 

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থপাচার, কর ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। বিদেশে টাকা পাচার করে সেই অর্থে ব্যবসার মালিকানা এবং ফ্ল্যাট ও বাড়ি কেনায় বিনিয়োগ করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ এই প্রবাদটি সত্য প্রমাণ করেছে আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন- যার চিত্র ক্রমেই উঠে আসছে। 

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে কানাডার সহযোগিতা কামনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি যমুনায় ঢাকায় নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার অজিত সিংয়ের সঙ্গে বৈঠককালে তিনি পাচার হওয়া সম্পদ শনাক্তকরণ, ফ্রিজ ও উদ্ধারে সহায়তা চান। তিনি বলেন- ‘সম্পদ পুনরুদ্ধারে আপনার সহায়তা প্রয়োজন। এটা আমাদের জনগণের টাকা।’

কানাডার হাইকমিশনার চুরি হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় কানাডার সহায়তার আশ্বাস দেন এবং উল্লেখ করেন যে, কানাডার সরকার কর্তৃক চিহ্নিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থ ফ্রিজ করার জন্য একটি ‘প্রক্রিয়া’ আছে। বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে সব আশ্বাস বাস্তবায়ন জরুরি।

একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি অর্থনৈতিক খাত, খাতটি একেবারে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা আর্থিক চিত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও ধনকুবেররা ১৭ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ দুই লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করেছে। মূলত ব্যাংক দখলে নেয়ার পর নতুন শেয়ারহোল্ডারদের ঋণ দেয়া এবং আমদানি খরচ বেশি দেখিয়ে এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। শুধু এ তথ্য নয়- বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অধিকাংশ অর্থই অর্থ পাচার হয়েছে। যা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি হয়েছে।
 
সরকারের দেড় দশকের ক্ষমতার প্রভাবে সংকট এমনভাবে ঘনীভ‚ত হয়েছে- অনেক ব্যাংকই অচল অবস্থা। তবে আশার কথা হলো- বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে এবং ফেরত আনতে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মানুষ সবসময় আশায় বাঁচে- বিষয়টি সত্য কিন্তু এই অপেক্ষা কতকালের সেটাও দেখার বিষয়। আশায় থাকতে থাকতে দেউলিয়া যেন না হয় জনগণ। এ অবস্থায় যারা অর্থ পাচারের পেছনে রয়েছেন, তাদেরও চিহ্নিত করা জরুরি। একদিকে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের কোমর ভেঙে দিয়েছে, আবার অর্থ পাচার- সবমিলিয়ে দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা যে কত বড় লাজুক অবস্থায় আছে তা বলার অপেক্ষা করে না। 

ব্যাংক খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতার জন্য অর্থ পাচার অনেকাংশে দায়ী। সন্দেহ নেই, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অর্থ পাচার অন্যতম প্রতিবন্ধক। এ চিত্র একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়। পাচারকৃত অর্থ দ্রুত ফেরত এনে এ অবস্থার উত্তরণ না ঘটালে আরও ভয়াবহতা দেখা দেবে, এতে আমাদের দেশের তরুণ সমাজের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য অর্থনীতির এসব পরিচিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে। 

শুধু হাসিনাচক্রের পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে নয়- রাষ্ট্রীয় তিন সংস্থার জোট দেশের সব পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে কঠোর হবে- এমনই প্রত্যাশা আমাদের।