ঢাকা–শরীয়তপুর সড়ক যেন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। চার বছর পার হলেও এখনো শেষ হয়নি এই জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের নির্মাণকাজ। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, প্রশাসনিক ধীরগতি আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয়তায় প্রকল্পটি এখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। এতে বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পরিবহন চালক ও ব্যবসায়ীরা।
২০২১–২২ অর্থবছরে শরীয়তপুর শহর থেকে নাওডোবা পদ্মা সেতু গোলচত্বর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব নেয় সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ)। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। তিনটি প্যাকেজে ভাগ করে কাজ শুরু হলেও চার বছর পেরিয়ে গেছে—কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর সদর থেকে জাজিরা টিএন্ডটি পর্যন্ত প্রায় ১৩.৫ কিলোমিটার অংশের কাজ সন্তোষজনকভাবে শেষ হলেও, টিএন্ডটি মোড় থেকে নাওডোবা পদ্মা সেতু পর্যন্ত বাকি ১৩.৫ কিলোমিটার অংশে এখনো ভূমি বুঝে না পাওয়ায় কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। এই অংশের মাত্র চার কিলোমিটার সারফেসিং সম্পন্ন হয়েছে, আরও তিন কিলোমিটারে প্রস্তুতিমূলক কাজ চললেও বাকি অংশ থমকে আছে।
বেহাল রাস্তা, প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন
সড়কের অসম্পূর্ণ ও ভাঙাচোরা অংশে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। এসব খানাখন্দে পড়ে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। পণ্যবাহী ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসের চালকরা বলছেন—এই রুট এখন “মৃত্যুর ফাঁদ”।
সেনেরচরের বাসিন্দা মনির মোল্লা বলেন, “চার বছর ধরে আমরা এ ভোগান্তির মধ্যে আছি। কোনো স্বজন অসুস্থ হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায় না। পদ্মা সেতুর এত কাছে থেকেও আমরা যেন অবহেলিত এক জনপদে বসবাস করছি।”
জাজিরা উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক সোহেল জানান, “আমরা যখন রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাই, তখন এই ভাঙা সড়কের কারণে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। গাড়ি ঝাঁকুনি খায়, রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। অনেক সময় তীব্র অসুস্থ রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে রাতে এই সড়কে চলাচল করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে গর্ত, অন্যদিকে খানাখন্দ—অ্যাম্বুলেন্স চালানো মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। আমি নিজে একাধিকবার দেখেছি, ভাঙা রাস্তায় দেরি হওয়ার কারণে রোগীর অবস্থা সংকটজনক হয়ে গেছে। এই রাস্তা দ্রুত মেরামত করা না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সরকার যদি একটু নজর দিতো, এই জেলার মানুষ স্বস্তি পেতো।”
সবজি ব্যবসায়ী শামিম হাওলাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কাজিরহাট থেকে ঢাকায় সবজি নিতে গেলে এই রাস্তা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। কিন্তু এই সড়ক যেন এক দুঃস্বপ্ন। আমরা মনে করি এখানে গাফিলতি আছে—এভাবে চললে এক যুগেও কাজ শেষ হবে না।”
সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বাসচালকরা। তাদের গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে, টায়ার লিক হচ্ছে, চাকার ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে।
ঢাকা রুটে চলাচলকারী বাসচালক সাহেব আলী বলেন, “নতুন গাড়ির পার্টস যেখানে পাঁচ বছর টেকে, এখন দুই বছরেই সব নষ্ট। লাভ তো দূরের কথা, রাস্তায় নামলেই লোকসান। যাত্রীরা অভিযোগ করে, কিন্তু আমরাও অসহায়।”
জাজিরার স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক মনে করেন, “এই রাস্তার কাজ নিয়ে সবাই শুধু আশ্বাস দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন শত শত ট্রাক, বাস, অ্যাম্বুলেন্স এই সড়ক দিয়ে যায়। এটা কেবল অবহেলা নয়, জেলার অর্থনৈতিক বিকাশের পথও রুদ্ধ হচ্ছে।”
এ বিষয়ে শরীয়তপুর সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, “আমাদের তিনটি প্যাকেজের মধ্যে প্রথমটির ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় প্যাকেজে দুটি সেতুর এপ্রোচ রোড ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে আছে। সবচেয়ে ধীরগতি তৃতীয় প্যাকেজে—টিএন্ডটি মোড় থেকে নাওডোবা পর্যন্ত। ভূমি বুঝে না পাওয়ায় কাজ এগোতে পারছি না।”
তিনি আরও বলেন, “কিছু জায়গায় এলএ কেসের সমস্যা সমাধান হলেও দখলে যেতে জটিলতা হচ্ছে। আমাদের সময়সীমা আগামী জুন পর্যন্ত। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় সময় আরও এক বছর বাড়তে পারে।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, শরীয়তপুর–ঢাকা সড়কের বিলম্ব শুধু সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নয়; এটি জেলার ব্যবসা, কৃষি ও পরিবহন খাতেও ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনছে। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে, কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, আর রোগীরা সময়মতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন—পদ্মা সেতুর মতো এক মহাপরিকল্পনার পাশে থেকেও শরীয়তপুরবাসী যেন উন্নয়ন বঞ্চনার শিকার।
বড় কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা কেবল রাস্তার সমস্যা নয়, পুরো জেলার মর্যাদার প্রশ্ন। দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন না হলে জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়বে।”
চার বছর ধরে চলমান এই সড়ক প্রকল্প এখন শরীয়তপুরবাসীর আক্ষেপের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতুর দোড়গোড়ায় থেকেও উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না জেলার মানুষ। স্থানীয়দের একটাই দাবি—“সময় নয়, কাজ চাই।”
সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি কার্যকর উদ্যোগ নেয়, তবে এই জনদুর্ভোগের অধ্যায় হয়তো শিগগিরই শেষ হবে।




Comments