Image description

আজ ১০ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক মধুপুর-ধনবাড়ী হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ী, ঘাটাইল ও কালিহাতীর এলেঙ্গা পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করেন। একাত্তরের এই দিনে এই অঞ্চলে উত্তোলিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা।

ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই টাঙ্গাইলে ‘স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ’ গঠন করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে গ্রামে গ্রামে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৩ এপ্রিল প্রথম পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে এ দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী ও মধুপুরের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে তারা পাক বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেন। এ সময় ধনবাড়ী অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে দুই পাক সেনা নিহত হয়।

ইতিহাসে আজকের দিনটি বিশেষ স্মরণীয়। একাত্তরের বিজয়ের এই ডিসেম্বর মাসে ধনবাড়ীর পানকাতা গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীরা প্রায় ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, গ্রামের ৭টি বসতবাড়িতে আগুন ধরিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। পরে পানকাতা গ্রামে শাহাদৎবরণকারী এই শহীদদের গণকবর দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, ধনবাড়ীর বীরতারা ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নোধা’র নেতৃত্বে বীরতারায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বীরতারা কদমতলী গ্রামের কদমতলী স্কুল মাঠে থাকা পাক বাহিনীর ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

বীর-কদমতলী ডাকঘরের অবসরপ্রাপ্ত ইডিডিএ কর্মচারী আবুল হোসেন এবং কদমতলী বাজারের ব্যবসায়ী এফাজ আলী স্মৃতিচারণ করে জানান, স্বাধীনতার সেই দিন এলাকা শত্রুমুক্ত করে কদমতলী স্কুল মাঠে পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। চারপাশ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। সেই থেকেই কদমতলী হাই স্কুল মাঠকে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা হাট’ নামকরণ করেন। আজও সেই যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জয় বাংলা হাটের বটগাছটি।

ধনবাড়ী উপজেলার পানকাতা গ্রামের গণকবরে শায়িত আছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ২৪ জন শহীদ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দীর্ঘ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই মধুপুর-ধনবাড়ীর এই একমাত্র গণকবরটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বীর শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং আগামী নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে এই গণকবরটি সরকারিভাবে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে ধনবাড়ী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও ধনবাড়ী প্রেসক্লাব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউছুব আলী বলেন, “পানকাতা গণকবরটি সরকারিভাবে সংস্কারের জন্য প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ প্রধান উপদেষ্টার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”

ধনবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান আলী জানান, বিজয়ের এই মাসে মহান মুক্তিযোদ্ধারা ধনবাড়ী ও মধুপুরে ১০ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত দিবসে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করে থাকেন। তবে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে পানকাতা গণকবরটি সংরক্ষিত করে সেখানে নামফলক বা স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি সকলের।

উল্লেখ্য, ১০ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মধুপুরের পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাসহ প্রায় ৩০০ রাজাকার ও আলবদরকে আটক করে এবং সেনা ঘাঁটিটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে এবং তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় উত্তর টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী, মধুপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জনপদ।