
চারদিকে সবুজ অরণ্যে ঘেরা পার্বত্য জেলা বান্দরবান। প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ব্যাপক আকর্ষণের একটি স্থান এই জেলা। একসময় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম, বিশেষ করে বান্দরবানে সীমান্তবর্তী সড়কে আলীকদম থেকে পোয়ামুহুরী পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অতি দুর্বল। দুর্গম পাহাড়ি পথের কারণে অনেক পর্যটকই এতদিন বঞ্চিত হতো বান্দরবানের গভীরের সৌন্দর্যে চোখ জুড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু ভ্রমণপিপাসুদের সেই আক্ষেপের দিন বুঝি এবার ফুরিয়ে এলো। আলীকদম থেকে জালানিপাড়া ও কুরুকপাতা হয়ে পোয়ামুহুরী পর্যন্ত সাড়ে ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের ফলে অপার সম্ভাবনা জেগেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এ পর্যটন স্পটে।
এ ছাড়া আলীকদম উপজেলায় জালানিপাড়া, কুরুকপাতা ও পোয়ামুহুরী সড়কটি স্থানীয়দের কাছেও অতি গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি স্থাপনার অপর্যাপ্ততার কারণে বেশ পিছিয়ে ছিল দুর্গম এই পাহাড়ি অঞ্চলের বিশাল জনপদ। দীর্ঘদিন সড়কটি না হওয়ায় সেসব এলাকাতে যাতায়াতের একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম ছিল নৌপথ। দুর্গম এলাকাগুলোতে যেতে সময় ব্যয় করতে হতো এক থেকে দুই দিন। কিন্তু আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়কটি নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগের সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নতির দিকে ধাবিত হবে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া পাহাড়ে বুক চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা দীর্ঘ সড়কটিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ৪টি ভিউ পয়েন্ট নির্মাণের ফলে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা জেগেছে পর্যটনে। আর এ পর্যটনকে কেন্দ্র করে প্রসারিত হবে দুর্গম এ অঞ্চলের অর্থনীতি।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে দ্রুত সম্পাদনের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয় সেনাবাহিনীর ওপর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইসিবির অধীনে ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের আগেই গুণগত মান বজায় রেখে সম্পন্ন করা হয় প্রকল্পটি। এ ছাড়া প্রকল্প ব্যয় থেকে ৩৫ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে সড়কটি নির্মাণে। জানা যায়, ৪৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকায় দুর্গম পাহাড়ের বুক চিরে নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে নান্দনিক এই সড়ক। পুরো প্রকল্পটিতে রয়েছে ৩৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার কার্পেটিং রাস্তা, ১০টি ব্রিজ, ১১টি কালভার্ট ও ৪টি ভিউ পয়েন্ট। ক্রস ড্রেন, সাইড ড্রেন, রিটেইনিং ওয়াল, আর্থ ওয়াটার ড্যাম, রোড সাইডসহ গুণগত সব মান বজায় রেখেই নির্মাণ করা হয়েছে সড়কটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার সবচেয়ে দুর্গম ৪ নং কুরুকপাতা ইউনিয়নে বসবাস প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পরিবারের। জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়কের দুর্গম পাহাড়ি জনপদে বিশাল ম্রো জনগোষ্ঠী ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। যাদের সবাই জীবিকা নির্বাহের জন্য জুম চাষের ওপরই নির্ভরশীল।
এ ছাড়া জাতীয় আয় হতে শতকরা ৩০ ভাগ কম দুর্গম আলীকদমের মাথাপিছু আয়। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা ও স্থাপনার অপর্যাপ্ততার কারণে খুবই কম উপজেলার দক্ষিণে বসবাসরত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার। ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডাক্তারের অপ্রতুলতার কারণে যুগ যুগ ধরে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেই বাস এ জনপদের মানুষের। বিশেষ করে কুরুকপাতা ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। নদীপথই ছিল একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম। পাশাপাশি দুর্গম অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং নিরাপত্তা অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনায় এ সড়ক নির্মাণ ছিল অতি জরুরি।
শুধু তা-ই নয়, দুর্গমতার কারণে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত হতেন স্থানীয় জুম চাষিরা। কিন্তু সড়কটি হওয়ায় এখন খুব কম সময়েই নিজেদের কৃষিপণ্য তারা খুব সহজে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন বাজারে। সময়মতো পৌঁছে যাওয়াতে পাচ্ছেন ন্যায্যমূল্যও। সড়কটি নির্মাণের ফলে বিশাল দুর্গম এলাকায় বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনে লেগেছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জোয়ার। যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি হওয়ার ফলে স্থানীয় ফল-ফলাদি অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে শহর থেকে বন্দরে।
জন ত্রিপুরা, মেনপং ম্রো, পেনরিং ম্রোসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সড়কটি হওয়ার আগে সব কিছু থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। এখন এই সড়কটি হওয়ার পর আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। এই সড়কের মাধ্যমে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের চিত্র পাল্টে যাবে, পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন এই সড়কটি দিয়ে ভিউ পয়েন্ট দেখতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকের আনাগোনা বাড়বে। ফলে এই এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে।
আলীকদম রিপোর্টাস ক্লাবে সভাপতি শুভ রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, দুর্গম হওয়াতে ওই এলাকা একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। কোনো অঘটন ঘটলেও খবর নিতে বেগ পেতে হতো। এই সড়কটি নির্মাণ হওয়ার ফলে এখন সহজভাবে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারছি দুর্গম সব এলাকায়।
এ ব্যাপারে ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের (১৬ ইসিবি) মেজর ও প্রকল্প কর্মকর্তা মো. ইশরাকুল হক বলেন, নব-িনর্মিত আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়কটি ৩১৭ কিলোমিটারের সীমান্ত সড়কের সঙ্গেও সংযুক্ত হচ্ছে। সড়কটি নির্মাণের ফলে মুরুং, ত্রিপুরাসহ বৃহত্তর কুরুকপাতা ইউনিয়নে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনে আর্থ-সামজিক উন্নয়ন আসবে। এ ছাড়াও তাদের কৃষিজাত পণ্যের বিপণন এবং কৃষিনির্ভর শিল্পোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে সড়কটি। দেশের ভূখণ্ড রক্ষা ও সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সড়কটি এ অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নতির পাশাপাশি সুখী, সমৃদ্ধ ও সুষম উন্নয়নের বাংলাদেশ গড়ার পথে এক বড় অর্জন।
Comments