Image description

মধ্য দুপুর। একদল সন্ত্রাসী দেশি-বিদেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায়। সেখানে বাধে সংঘর্ষ। সংঘাতের এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা চাপাতি দিয়ে কোপ দেয় কাউসার দেওয়ান (৪২) নামের এক ব্যক্তিকে। হাসপাতালে নেয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। দিনে-দুপুরে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উঠে এসেছে এম এ কাইয়ূমের নাম। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

শুধু এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই নয়, সাম্প্রতিককালে ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বাড্ডা, খিলক্ষেতসহ আশপাশের এলাকায় নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ কায়েম করেছেন ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত এই কাইয়ূম। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়াও মামলা দিয়ে হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয়রা বলছেন, এম এ কাইয়ূম পুরো এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আওয়ামী লীগ আমলেও একইভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতো সে। এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রতিকার চেয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

দিনে-দুপুরে হত্যা: সোমবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে খিলক্ষেতের বড়ুয়া এলাকার পূর্বদিকে স্বপ্নসিঁড়ি প্রকল্প দখলে আসে এম এ কাইয়ূমের অনুগত ৩০০-৪০০ জনের একদল সন্ত্রাসী। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে করে আসা ওই সন্ত্রাসীদের হাতে ছিল দেশি-বিদেশি অস্ত্র। এক পর্যায়ে তারা পার্শ্ববর্তী আশিয়ান সিটিতে কর্মরত কর্মকর্তাদের ওপর ধারালো অস্ত্র ও পিস্তল দিয়ে উপর্যুপরি হামলা চালায় ও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় মোবারক দেওয়ান নামে এক সন্ত্রাসী ফাহিম ভূঁইয়া ও জিহাদ নামে দুই কর্মচারীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। তারা দুজন গুরুতর আহতসহ সেখানে ১০ জনের বেশি আহত হয়। সেখানে লুটপাটও করে তারা। পরে পালিয়ে যায়। সেখানেই গুরুতর আহত একজনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় এরই মধ্যে খিলক্ষেত থানায় অভিযোগ করেছে আশিয়ান সিটি। ওই ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়- মোবারক দেওয়ান দলবল নিয়ে এলাকাবাসীর ফসলি জমি দখলের চেষ্টা করছে।

আশিয়ান সিটি কর্তৃপক্ষ বলছে, চাঁদা না পেয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে কাইয়ূম কমিশনারের সন্ত্রাসীরা।

সূত্র বলছে, কাইয়ূমের অনুসারীরা স্বদেশ প্রোপার্টির ভেতরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটালেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে এ সংক্রান্ত মামলায় আশপাশের আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জড়ানোর চেষ্টা করছেন।

খিলক্ষেত থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ আজহারুল ইসলাম বলেন, ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।

বিএনপি কর্মীদের মামলায় ফাঁসানো, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাঁচানো: শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের হত্যা মামলাসহ অন্যান্য মামলা থেকে রক্ষা করার মিশন নিয়ে মাঠে নামেন এম এ কাইয়ূম। খিলক্ষেত ও উত্তরখান থানার বিভিন্ন মসজিদে বসে স্বৈরাচারের দোসরদের নিয়ে দেন-দরবার করেন তিনি। সম্প্রতি বিএনপি কর্মী চিহ্নিত সন্ত্রাসী মোবারক দেওয়ান, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানকারী গোল্ডেন মনির, আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য মো. ইব্রাহিমের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে তাকে। এদিকে এম এ কাইয়ূম ও তার আওয়ামী সহযোগীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কাইয়ূমকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে। এম এ কাইয়ূমের সহযোগী খিলক্ষেত ও উত্তরখান এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী বিএনপির মোবারক দেওয়ান ও আওয়ামী লীগের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি মোহাম্মদ মোমেন ও সাধারণ সম্পাদক মোকতারসহ দুই দলের নেতাকর্মীরা একাধিক বৈঠক করেছেন। অন্যদিকে বাড্ডাসহ আশপাশের থানায় হওয়া একাধিক মামলায় স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে কাইয়ূম ভূমিকা রাখেন বলে জানা যায়।

আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পদের রক্ষাকর্তা: ঢাকা-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াকিল উদ্দিন ও স্বর্ণ চোরাকারবারি গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে এম এ কাইয়ূমের। এই তিনজনের মিলিত আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বদেশ প্রোপার্টিজ। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা পালালেও তাদের ব্যবসার দেখভাল করছেন কাইয়ূম। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই দুজনের সহায়তা নিয়ে মালয়েশিয়া পালিয়ে ছিলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ আমলে কাগজে-কলমে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ওয়াকিল উদ্দিন ও গোল্ডেন মনিরের পেটুয়া বাহিনী দিয়ে নিজের স্বদেশ সাম্রাজ্য বিস্তারে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তিনি করেননি। দখলদারিত্বের মাধ্যমে শত শত কৃষকের ফসলি জমি এবং সরকারি খাস জমিসহ জলাশয় ভরাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট বানিয়ে বসেন এই কাইয়ূম। সম্প্রতি জলাশয় ভরাট করে দখলদারিত্ব চালানোর দায়ে স্বদেশ স্বর্ণালী ভ্যালি প্রজেক্টের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক।

শূন্য থেকে বিলাসী জীবন: নরসিংদীর রায়পুরার বেলাবো থেকে দেড় যুগ আগে জীবিকার খোঁজে ঢাকায় এসে গুলিস্তানে ফুটপাতে ভ্যানে করে গামছা বিক্রি শুরু করেন কাইয়ূম। নিজের চতুরতাকে কাজে লাগিয়ে হাত মেলান গুলিস্তানের ফুটপাতের চাঁদাবাজদের সাথে, ক্ষমতাসীন চাঁদাবাজদের সাথে মিশে বনে যান গুলিস্তানের পরিচিত মুখ। চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের সাথে সুবিধা না করতে পারায় জীবিকার মোড় ঘুরিয়ে শ্রমিকদের মাঝে নিজের আধিপত্য গড়ে তুলে হয়ে ওঠেন শ্রমিক নেতা। আর সেখান থেকেই একে একে সখ্যতা গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির সাবেক বর্ষীয়ান নেতাদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের সঙ্গে। কৌশলে বনে যান হাজার কোটি টাকার মালিক। নিজে ২ কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি ব্যবহার করেন। আর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের জন্য রয়েছে আরো দামি গাড়ি। নামে-বেনামে রয়েছে বহু প্লট ও বাড়ি।

লাখো কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক এম এ কাইয়ূম তার নির্বাচনী হলফনামা এবং আয়কর বিবরণীতে দেখিয়েছেন সামান্য কিছু খরচ। যা একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের খরচের কাছাকাছি। তিনি দেখিয়েছেন- ভাড়া থেকে প্রাপ্ত বাৎসরিক আয় ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮৪০ টাকা। ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২২৪ টাকা। অথচ আয়কর নথিমূলে দেখানো কাইয়ূমের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব- দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, গুলশান ব্রাঞ্চ (এফডিআর) (১০০১), জমাকৃত ৩৩ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৩ টাকা। দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, গুলশান ব্রাঞ্চ (এফডিআর) (১০২০), জমাকৃত ৩২ লাখ ১০ হাজার ৬৯৩ টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক লিমিটেড, গুলশান ব্রাঞ্চ (এফডিআর), জমাকৃত ১৮ লাখ ১ হাজার ৯৪৩ টাকা। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেড, বনানী ব্রাঞ্চ, জমাকৃত ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকা। দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, গুলশান ব্রাঞ্চ, ঢাকা (২০০১), জমাকৃত ১ লাখ ৫৬ হাজার ১১২ টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, গুলশান ব্রাঞ্চ, জমাকৃত ১ হাজার ৪৮১ টাকা।

এছাড়া ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, বারিধারা ব্রাঞ্চ (২৫৮১), জমাকৃত ২ লাখ ২০ হাজার ৫৩০ টাকা। আয়কর বিবরণীতে এম এ কাইয়ূমের রয়েছে মোট ৯ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ১০২ টাকা। কিন্তু এসবের উৎস সম্পর্কে কোনো বিবরণ দেয়া নেই। কাইয়ূমের প্রথম আয়কর বিবরণীতে লক্ষাধিক টাকার সম্পদ দেখালেও ২০২৪/২৫ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার অর্থসম্পদের মালিক দেখিয়েছেন নিজেকে। যদিও তার এক স্বদেশ প্রপার্টিজেই রয়েছে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। অন্যদিকে নির্বাচনী হলফনামা ও আয়কর বিবরণীতে সামান্য কিছু খরচ দেখিয়ে এম এ কাইয়ূম আড়াল করেন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। এতে তিনি বাৎসরিক আয় দেখিয়েছিলেন বাড়ি ভাড়া থেকে ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮৪০ টাকা এবং ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২২৪ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দেখিয়েছিলেন ৯ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ১০২ টাকা। কিন্তু এসবের উৎস সম্পর্কে কোনো বিবরণ দেয়া নেই সেখানে। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে বছর শেষে ২০২৪/২৫ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার অর্থসম্পদের মালিক দেখিয়েছেন নিজেকে।

দুদক সূত্রে জানা যায়, তার প্রদত্ত সম্পদের বিবরণীতে উৎস বিবর্জিত যা আছে এবং আয়বহির্ভূত বিষয়গুলো নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানে মাঠে নামছে দুদক। এসব বিষয়ে জানতে এম এ কাইয়ূমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মানবকণ্ঠ/এসআরএস