Image description

জাতিসংঘ নামক দরবার তথা বিশ্বদরবারে নিজেদের কথা নিজেদের ভাষায় বলতে পারা যেকোনো জাতির জন্যই গৌরবের। সেই গৌরব আরও একবার আমাদের ভাগ্যে জুটলো গত ২৭ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। কারণ, এইদিন জাতিসংঘ সদর দপ্তরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অবশ্য এই ভাষণকে ‘ভাষণ’ বললে সম্ভবত খানিকটা ভুলই বলা হয়। বলতে হবে- আমাদের কথা, আমাদের মনের কথা, আমাদের প্রাণের কথা। যে কথাগুলো নিঃসংকোচে এবং সগর্বে আমরা জানাতে চেয়েছিলাম বিশ্বকে। 

জি, অবশেষে আমরা জানিয়ে দিয়েছি। আর বিশ্ব কান পেতে শুনেছে। শিহরিত হয়েছে, বিস্মিত হয়েছে আমাদের গৌরবগাথায়। আর এরই মধ্য দিয়ে ঘোষণা করা হয়ে গেছে অন্য এক বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ অস্তিত্ব। যে অস্তিত্ব সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেবল শক্তিশালী হতে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। 

বক্তব্যের শুরুতেই ‘সামিট ফর দ্য ফিউচার’ আয়োজনের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের দূরদর্শী ভূমিকার জন্য প্রশংসা করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এরপরই উপস্থাপন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের প্রসঙ্গ। যে আন্দোলনের কারণে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে নতুন এই প্রেক্ষাপট। উদিত হয়েছে নতুন সূর্য। তিনি বলেন, শুরুতে এই আন্দোলন কেবলই কোটা সংস্কারের আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল। তারপর এটি রূপ নেয় গণমানুষের আন্দোলনে। আর এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে গোটা বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল রাজপথ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

আন্দোলনকারীদের আত্মবিশ্বাস, প্রজ্ঞা, সাহস আর প্রত্যয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিল আমাদের তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। স্কুল-পড়–য়া কিশোর-কিশোরীরা জীবন উৎসর্গ করেছিল নির্ভয়ে, নিঃসংকোচচিত্তে। শত শত মানুষ তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে চিরতরে। আন্দোলনের হতাহতের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আমার জানামতে আটশ’রও বেশি জীবন আমরা হারিয়েছি এই স্বৈরাচারী অপশক্তির হাতে। তিনি আরও বলেন, এই ‘মুনসুন অভ্যুত্থান’ আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও তুলে ধরেন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। তিনি বলেন- যে রাষ্ট্রকাঠামো দুঃসহ হয়ে গেছে, তার পুনর্গঠনের জন্য আমাদের তরুণরা এবং দেশের আপামর জনসাধারণ আমার ও আমার উপদেষ্টা পরিষদের উপর আস্থা রেখে সরকার পরিচালনার এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সুতরাং অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল্য লক্ষ্য। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত কী কী করেছে, এর একটা বিবরণও দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন- দায়িত্বভার গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা গুম প্রতিরোধে যে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাতে যোগদান করেছি। এর আশু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দেশীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকারের চলমান কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বরাবরই অবদান রেখেছে বাংলাদেশ। এই অবদান ভবিষ্যতে আরও জোরালো এবং সমুন্নত হবে, এমন প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

এরপর তিনি আহ্বান জানান জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন- জলবায়ু পরিবর্তন সবার অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই গ্রীষ্মে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকারী তাপপ্রবাহ আমাদের জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কথা স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দিয়েছে। তাই আমাদের উচিত জলবায়ু সম্পর্কিত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ড. ইউনূস তার ভাষণে জাতিসংঘকে তিন শূন্য ধারণা দেন, যা সত্যিই অভিনব। তিনি বলেন- আমি বিশ্বাস করি, সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে তিন ‘শূন্য ধারণা’ এর ধারণা বিবেচনা করতে পারে। যার মাধ্যমে আমরা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। যেখানে তরুণ-তরুণীরা চাকরি প্রার্থী না হয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাবে। 

এরপর তিনি তুলে ধরেন যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা। বলেন, নানামুখী সংকটে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে ব্যাপক আকারে মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিশ্ববাসীর নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলিম বিশ্বের জন্যই আশঙ্কার নয়, বরং গোটা মানবজাতির জন্য উদ্বেগজনক। তাই তিনি উভয় পক্ষকে সংলাপে বসে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান। তিনি আরও আহ্বান জানান রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তার। আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করেন পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে।

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন- রাজনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জাগরণ ব্যতীত শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। এরপর তিনি কথা বলেন অভিবাসন ও মানুষের অবাধ প্রবাহ বিষয়ে। যার ব্যাখ্যা এমন- বিশ্বে এখন প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন। সবার জন্য অভিবাসনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের পথ সুগম করতে হবে। ড. ইউনূস আহ্বান জানান নতুন ধরনের সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলার। তিনি বলেন- আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এমন একটি রূপান্তরকারী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা কর্মসংস্থান, আর্থ-সামাজিক প্রতিকূলতা বা জীবিকার জন্য যুতসই সমাধান নিশ্চিত করবে। 

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসে ড. ইউনূস বর্ণনা করেন মহামারী করোনার সময়কালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। তাই তিনি দাবি করেন, জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা গণমানুষকে সুস্থ জীবনযাপন করতে সহায়তা করবে। সম্পদের সুষম বণ্টন না হলে সমাজের ভারসাম্য রক্ষা হয় না। তাই তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন- আসুন আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে সকল প্রকার বৈষম্য ও অসমতার অবসানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।

ড. ইউনূসের এই ভাষণ সারাবিশ্বে এখন বহুল আলোচিত এবং প্রশংসিত। তবে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এখনও জানেই না প্রকৃত বিষয়টা আসলে কী। অর্থাৎ জাতিসংঘে ভাষণ দিলে কী হয় বা হতে পারে। এতে কতটা লাভ, কার লাভ। তবে হ্যাঁ, তারা ঠিকই বুঝতে পারবে, যখন ভাষণের প্রতিটি কথার প্রতিফলন দৃশ্যমান হবে। অর্থাৎ ভাষণ কেবল ভাষণ হিসেবেই থেকে যাবে না, মানুষ এর উপকার ভোগ করতে পারবে। এটাও ঠিক, সব উপকার এতটা দ্রুত হাতের মুঠোয় আসে না। ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। বিশ্বাস রাখতে হয়- সবুরে মেওয়া ফলে। 

আমরা বিশ্বাস করি, হাতেগোনা কিছু মানুষ ক্ষণে ক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠলেও অধিকাংশ মানুষই ধৈর্যশীল। তারা স্থিরতার সঙ্গে ততদিন অপেক্ষা করবেন, যতদিন না ড. ইউনূসের ভাষণের প্রতিটা কথা, প্রতিটি প্রতিশ্রুতি আমাদের কাছে ধরা দেবে স্বপ্ন পূরণের আনন্দ হয়ে। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও টিভি উপস্থাপক।


মানবকণ্ঠ/এফআই