Image description

জীবন বাঁচাতে প্রতিদিন কী ধরনের খাবার খাচ্ছি আমরা? নিরাপদ খাবার কি? নিশ্চয়ই না। সুস্থ শরীরের জন্য অবশ্যই দরকার স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাবার। এটির যোগান পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকারও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে- যুগ যুগ ধরে ভেজাল ও নকল খাবারে দেশের বাজার সয়লাব হয়ে থাকায় নিরাপদ খাদ্যের ধারণাই মানুষ ভুলতে বসেছে। কোথায় নেই ভেজাল? 

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়- শাক-সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, কপার সালফেট, জিলাপি-চানাচুরে মবিল, আইসক্রিম, জুস, সেমাই, আচার, নুডলস, মিষ্টি ইত্যাদিতে টেক্সটাইল ও লেদার রঙ, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ, মসলায় কাউন ও কাঠের গুঁড়া, ঘি এ কৃত্রিম রঙ, শরবত ভোজ্যতেলে কেমিক্যাল, টোস্ট বিস্কুটে বিষাক্ত সাইক্লোমেট, কনডেন্সড মিল্কে পামওয়েল, প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার ইত্যাদিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, আম, লিচু, আনারস, জাম ও অন্যান্য ফলে কার্বাইড ও ফরমালিন, যা এগুলোকে দীর্ঘকাল তাজা রাখে, শুঁটকি ও চালে বিষাক্ত ডিডিটি পাউডার ইত্যাদি রয়েছে। সিরিঞ্জ দিয়ে তরমুজের ভেতরে দেয়া হয় তরল পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, যাতে তরমুজের ভেতরটা থাকে লাল টকটকে। ক্যালসিয়াম কারবাইড দিয়ে পাকানো হয় কলা। দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণের জন্য মাছে দেয়া হয় ফরমালিন। মাছকে ইউরিয়া সার, এমনকি ফার্মের ব্রয়লার মুরগির বর্জ্যও  খাওয়ানো হয়, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। 

পোল্ট্রি বা ফিস ফিডে হেভিমেটালযুক্ত উপাদান থাকে, যা মাছ বা মাংসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। মসলায় ইটের গুঁড়ো এবং হলুদে লেড আইয়োডাইড মেশানো হয়। কৃষি জমিতে দেয়া কীটনাশকে ক্ষতিকর যে হেভিমেটাল থাকে তা ফসলের সাথে কিছুটা যুক্ত হয় এবং খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা চলে যায় আমাদের পেটে। কীটনাশকের পরিমিত ব্যবহার জরুরি হলেও বেশি ফলন ও বেশি লাভবান হওয়ার আশা কৃষককে অতিমাত্রায়, এমনকি নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহারেও প্রলুব্ধ করে তুলছে। 

ভেজাল খাবার ছাড়াও বাজারে আসছে নকল পণ্য। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো- প্যাকেটের গায়ে আসল পণ্যের হুবহু নকল সিল-মনোগ্রাম, এমনকি অনেকক্ষেত্রে বিএসটিআই এর নকল অনুমোদনপত্রও ছাপা হয়ে যাচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ। তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করার সুযোগ না থাকায় নকল পণ্যের দাপটে এখন আসল পণ্য চেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে খাবারে অবাধে মিশিয়ে যাচ্ছে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। এসব পদার্থ মেশানো ভেজাল খাবার পেটে গিয়ে শরীরের লিভার, পাকস্থলী, কিডনি, দৃষ্টিশক্তিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে, যা একসময় মরণব্যাধি ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে- প্রতিবছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতিবছর মারা যায় প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। মহাখালী পাবলিক হেল্থ ইনস্টিটিউটের এক তথ্যানুযায়ী দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত। ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দেলন’ এক গবেষণায় বলছে- শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ডায়বেটিসে প্রায় দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এই ভেজাল খাবারের জন্য বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যাও প্রায় ১৫ লাখ। এসব উদ্বেগজনক তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, হচ্ছে কিন্তু কে শোনে কার কথা? ভেজাল, নকল খাবারের উৎসমুখ বন্ধের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আজো দৃশ্যমান নয়। ফলে বাধ্য হয়ে এসব ভেজাল ও নকল খাবার খেয়ে লাখো মানুষ যেমন বিভিন্ন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগছে, অকালে প্রাণও হারাচ্ছে, তেমনি নতুন প্রজন্ম এক মেধাহীন পঙ্গু নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠছে। তাই সবার জন্য চাই নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভেজালবিরোধী অভিযান মাঝেমধ্যে চললেও ভেজাল রোধে তা যথেষ্ট কার্যকর নয়। তাই আইন প্রয়োগ ও নিয়মিত অভিযান চালানোর পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিকে একটি   সামাজিক আন্দেলনে রূপ দিতে হবে। 

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহও অসম্ভব। এজন্য আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চাষাবাদের জন্য কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। এদেশে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর রয়েছে। রয়েছে নিরাপদ খাদ্য আইন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে তৎপর হতে হবে বেশি করে। সংস্থাটির খাদ্যভোগ ও ভোক্তা অধিকার বিভাগের সদস্য মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানটির জনবলের অভাবসহ নানান সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্য অনিরাপদ হতে পারে। কিন্তু এসব দেখভালের জন্য যে জনবলের প্রয়োজন, তা খুবই সীমিত। তারপরেও আইন অনুযায়ী ভোক্তাদের সচেতন করা, প্রশিক্ষিত করা, খাবার নিরাপদ করার ক্ষেত্রে যেসব সাধারণ নিয়মাবলি রয়েছে সেসব জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সচেতনতা তৈরি হলেই কি মানুষ বুঝবে যে এই খাবার নিরাপদ, না নিরাপদ না? 

এ প্রশ্ন তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেছেন- সরকারের যে সমস্ত সংস্থা খাদ্য সরবরাহ পর্যায়ে বিভিন্ন অনুমতি দিয়ে থাকে তাদেরকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। তখন হয়তো ক্রেতারা একটু নিশ্চিন্তে খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে- বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবসা করতে এখনও পর্যন্ত কোনো লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম নেই। বিষয়টি আইনের আওতায় আনতে অবশ্যই প্রচলিত আইনের সংশোধন প্রয়োজন। তবে এ বিষয়ে খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন-নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা শুধু আইনের বিষয় না, এটা একটা সংস্কৃতির বিষয়ও। এই সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, বিক্রয় ও ভোক্তার খাদ্য গ্রহণ-এসবের প্রতিটি স্তরে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ও ভোক্তাদেরকে প্রয়োজনীয় ধারণা বা প্রশিক্ষণ দেয়াসহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর/অধিদপ্তরসমূহ, এনজিও, ভোক্তা ও বিএসটিআইএর সমন্বিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে। 

উন্নত দেশগুলো কীটনাশকসহ ক্ষতিকর উপাদানের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা অবলম্বন করে ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের খাবারের মানকে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এ দেশেও এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষকে ভেজাল, নকল খাদ্য ও বিশেষ করে কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি যারা মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য নিয়ে খেলা করে মানুষের বেঁচে থাকাটাকেই হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তাদের ভেজালবিরোধী আইনের আওতায় এনে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ যেমন আশা করা যাবে, তেমনি ভেজালের হোতারাও নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হবে। 

লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি