Image description

‘রাজা আসে যায়, রাজা বদলায়, নীল জামা গায়, লাল জামা গায়, এই রাজা আসে ওই রাজা যায়, জামা কাপড়ের রং বদলায়, দিন বদলায় না’-কবি বিরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতার লাইন কটি বা সত্যজিত রায়ের সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশ’-এর কাহিনির পটভূমি বদলাবার কোনো উপায় যেন এ দেশে নেই। আমাদের অবস্থা হয়েছে একেবারেই সেই রকম। বার বার স্বাধীনতা আসে, পরাধীন থেকে স্বাধীন হই, প্রভু বদলায়, পতাকা বদলায়, জাতীয় সঙ্গীত বদলায়, ফুল-পাখি বদলায়, কিন্তু স্বাধীন হতে পারি না, মুক্তি আসে না। নিজেদের মধ্য থেকেই দানবের মত শাসক তৈরি হয়, শাসন করে দোর্দণ্ড প্রতাপে, ভয় করে শাসকের সামনে পড়তে। ইউরোপ থেকে এসে সুদীর্ঘ একশত নব্বই বছর ব্রিটিশরা এ দেশ শাসন করেছে, শাসনই করেছে এদেশের মানুষকে মানুষই মনে করেনি, ভালোও বাসেনি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে রক্ত দিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে দেশ স্বাধীন হলো। এই স্বাধীনতা এমনভাবে এলো- দেশ ভাগ হয়ে খণ্ডিত হলো, আর এই খণ্ডিত অংশ নিয়েই মানুষের আনন্দ যেন আর ধরে না। সোনার পাথর বাটি হাতের মুঠোয়। স্বপ্ন ফিকে হতে বেশি সময় লাগল না। 

পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় গণতন্ত্রের বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। এই স্বাধীনতা আরও যেন ভয়ঙ্কর। পশ্চিম পাকিস্তানিরা হয়ে উঠল নতুন ঔপনিবেশিক প্রভু, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি হলো নতুন ঔপনিবেশ। ব্রিটিশরা তবু জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সভ্যতায় উন্নত ছিল, এরা একেবারেই বর্বর। বন্দুক, কামান, জেল, জুলুম ছাড়া কিছুই বুঝে নাই। শুধু শোষণই বুঝেছিল ভালো। ২৪টি বছর এদেশবাসীর জীবন নরক বানিয়ে রক্ত বন্যায় ভেসে লজ্জাজনক পরাজয়ের মাধ্যমে বিদায় নিল। দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন হলো। নতুন মানচিত্র, নতুন দেশ, নতুন পতাকা। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলো বটে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ মুক্তিলাভ ঘটেনি। স্বদেশী শাসক শ্রেণি তৈরি হলো, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা বহালই থাকল। ফলে রাষ্ট্র ও প্রশাসন স্বাধীন দেশ ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারল না। দেশের নাম পরিবর্তন হলেও দেশের আইন-কানুন, আমলাতন্ত্র রয়ে গেল সেই ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের ভাবধারায়। সামরিক-বেসামরিক আমলাশ্রেণি কখনও রাজনীতিক নাম পরিচয়ধারী বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণিকে উপলক্ষ করে, কখনও বা সরাসরি দেশ শাসন করেছে। বেশিরভাগ সময় প্রকৃত শাসনকর্তা তারাই রয়ে গেছেন। 

১৯৯১ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরার একটা আবহ তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এজন্য অনেক আন্দোলন করেছিল। ২০০৮ সনে ক্ষমতায় এসে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার সর্বনাশা নেশায় তাদের পেয়ে বসে। অগণতান্ত্রিকতার দোহাই দিয়ে বিচার বিভাগের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সনে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনটিতেই ক্ষমতাসীন দল বা জোট জয়লাভ করে। এই তিনটি নির্বাচনকে নির্বাচন না বলে প্রহসন বলাই বেশি মানানসই। এই তিনটি নির্বাচন তিন রকমের উপাধি পায়। বিনা ভোট, রাতের ভোট ও ডামি ভোটের নির্বাচন। শান্তিপূর্ণভাবে জনরায়ের মাধ্যমে বৈধভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সকল পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় নির্বাচনই শুধু নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও একই পরিণতি লাভ করে। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকল। 

২০২৪ সনের মধ্যভাগে এসে সামান্য ঘটনা থেকে এই ক্ষোভ জনবিস্ফোরণে রূপ নেয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাস এবং আগস্ট মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা হয়েছেÑ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থায় পোক্ত হয়ে বসা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে এবং শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। তবে ছাত্র-জনতার এত বিপুল সংখ্যায় জীবন দানের ঘটনা বাংলাদেশের  ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজারের কাছাকাছি মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে, আহতের সংখ্যাও বিশ সহস্রাধিক। এখনও হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর খবর আসা বন্ধ হয়নি। অনেকে চির জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। শেখ হাসিনা এবং তার দল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বেপরোয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুধু ব্যাপক মাত্রার শক্তি প্রয়োগই নয়Ñ ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে অনেক পুলিশ সদস্যকেও প্রাণ হারাতে হয়েছে, অনেকে ভয়ে পালিয়ে গেছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখনও পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এই সকল আত্মাহুতির একটা জন-আকাক্সক্ষা ছিলÑ দেশের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের মুক্তি। তার ঘনিষ্ঠ মহল এবং দলের লোকজনদের মধ্যে একটা বড় অংশ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল। 

তার নিজের জবানিতেই জানা যায়, তার বাসার কাজের লোকও চারশ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে, হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি এদেশের সব সরকারকেই গ্রাস করেছে, কেউই দুর্নীতি মুক্ত নয়। কিন্তু বিগত সরকারের সময় কোনো বিষয়ে কারও কথা বলার বা প্রতিবাদের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। বিরুদ্ধবাদীদের জন্য ছিল গ্রেপ্তার, জেল, গুম, নির্যাতন, হয়রানিসহ আরও অনেক রকম শাস্তি। এমনকি কুখ্যাত ‘আয়নাঘর’ নামক কয়েদখানার কথা পর্যন্ত শোনা যায়। দেশের সবকিছু তার এবং তার দোসরদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশব্যাপী একটি চাটুকার শ্রেণিই তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনার বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনেও এই চাটুকারিতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। 

শেখ হাসিনার পতনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক একটি অংশ ধরেই নিয়েছে, রাষ্ট্রের উপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মুক্তি মিলবে। আশাবাদী হতে কার না ইচ্ছা করে, ইতিহাস আবার সে কথা বলে না, তাই হতাশাও ভর করে। একাত্তর সালেও জনগণ অনেক আশা নিয়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, লক্ষ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে, নয় মাস যুদ্ধের পর বিজয় অর্জিত হয়েছে। মানুষ তখনও ভেবেছিল দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের উপর মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মুক্তি মিলবে। কিন্তু না, দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের উপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং মুক্তিও আসেনি। 

আন্দোলন সংগ্রাম, জীবনদান, বিজয় অর্জন হলেও কী করে যেন একটি শাসক গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যায়, রাষ্ট্র তৈরি করে নেয়। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা, সম্পদ তাদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যায়। জনগণ সেবাদাসে পরিণত হয়। এই শাসক শ্রেণি তৈরি হওয়ার মর্মমূলে কি করে আঘাত করা যায়, জনগণের মালিকানা কীভাবে ধরে রাখা যায়, সেই চিন্তাই হওয়া দরকার মুখ্য বিষয়। না হয় ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বা গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতিতেও ধুলা জমবে, যেমনি জমেছে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিতে এবং ১৯৯১-এর গণ আন্দোলনের স্মৃতিতে। এত ত্যাগ, সংগ্রাম, যুদ্ধের পর এই অবস্থ্া কাম্য ছিল না। আর কতবার ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত দিবে, দিয়েই বা কী হবে!

এখন একটা প্রশ্ন হলো শেখ হাসিনা কেন স্বৈরাচার হয়ে উঠলেন! তার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। তিনি একটি রাজনৈতিক পরিবার, দল থেকে এসেছিলেন। এককভাবে কেউ কি স্বৈরাচার হয়ে উঠতে পারে! সম্ভবত না। একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, সকল স্বৈরাচার শাসকেরই স্বৈরাচার হয়ে ওঠার পেছনে অনেক মানুষের অবদান থাকে। কেউ একা একা স্বৈরাচার হতে পারে না। অনেক মানুষ মিলে একজনকে স্বৈরাচার করে তোলে। শেখ হাসিনারও স্বৈরাচার হয়ে ওঠার পেছনে কত মানুষের কত অবদান। কে নেই সেই তালিকায়Ñ বুদ্ধিজীবী, সুশিল সমাজ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আমলা, পুলিশ, বিচারপতি, রাজনীতিবিধ। সাংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রাজনীতিবিদ এমনকি আমলাদের বক্তব্য শুনলে এ অভিযোগের উত্তর সহজেই মিলবে। অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ অপ্রয়োজনীয়ভাবেও শুধু নিজেদের আখের গোছানোর জন্য জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। 

কোনো বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করলেও সবাই শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখার এক অদ্ভুত কৌশলে এটা করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কোথাও কোনোভাবে তার কোনো সমালোচনা বা কাজের প্রতিবাদ কেউ করলে সারাদেশে থানায় থানায় মামলা মোকদ্দমার হিড়িক পড়ে যেত। একেকজন এমপি নিজ এলাকার জমিদার বা রাজপূত্রের মত আচরণ করতেন। কাউকে সম্মান দেয়া বা তোয়াক্কা করা তো দূরের কথা, অনেকে আইন-কানুনও মানতেন না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে মন্ত্রী এমপিগণ রূপকথার আশ্চর্য প্রদীপ যেন হাতে পেয়ে যেতেন। সবাই যদি এরকম আচরণ না করতেন, সময়মত ন্যায্য কথাটি বলতেন তাহলে কি পরিস্থিতি এমন হতো! অবশ্যই না। শুধু শেখ হাসিনা নয়, সকল একনায়ক বা স্বৈরাচারের উত্থান ও বিস্তারের পেছনেই এ রকম একটি অনুগত বংশবদের অবদান থাকবেই, তবে দায়ভাগ নিতে কেউ রাজী নয়, এরা একে অন্যকে ব্যবহার করে মাত্র। প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই একটা আমিত্ব বোধ কাজ করে। পরিবেশ, পরিস্থিতি, মূল্যবোধের কারণে এটার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি কারও স্বৈরাচার হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিরাট বাধার প্রাচীর হয়ে না দাঁড়িয়ে অনুকূল পরিবেশ এবং রসদ যোগান দেয় তাহলে কোনো গণতন্ত্রীর পক্ষেও নিজের অবস্থান ধরে রাখা কঠিন। 

তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকেই হতে হবে সকল অন্যায়, অবিচার, অন্যায্য কাজের বিরুদ্ধে বিরাট বাধার প্রাচীর। কেউ যেন এটা টপকাতে না পারে। অধিকার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে সকল নাগরিকই সমান, রাষ্ট্রকে সেভাবেই নির্মাণ করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্র অনেক বড় মূল্যবোধের বিষয় হলেও জনগণের রায় বা ভোটাধিকার এর প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যে কোনো নেতা বা শাসককে গণ জবাবদিহির আওতায় রাখার জন্য জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণ রাষ্ট্রের মালিকÑ ভোটাধিকার না থাকলে বা ভোট নিয়ে নয়ছয় করার সুযোগ থাকলে এই মালিকানা প্রমাণের আর কোনো পথ থাকে না। রাষ্ট্র কল্যাণমূলক চরিত্র হারিয়ে গোষ্ঠী বিশেষের হয়ে যায়। জনগণকে আগে রাষ্ট্রের মালিক হতে হবে, তবেই ধীরে হলেও মুক্তির পথও তৈরি হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি