জীবনের জন্য, জীবনের সফলতার জন্য এবং মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য প্রয়োজন বই। বই পড়া মানসিক, জ্ঞানগত এবং সামাজিক উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি মানুষের চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সাহায্য করে। বই জ্ঞানের আধার। বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ার মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন তথ্য ও ধারণা অর্জন করতে পারি, যা আমাদের পরবর্তীতে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাহায্য করে।
একটি ভালো বই মানুষের মনশ্চক্ষু যেমন খুলে দেয় তেমনি জ্ঞান ও বুদ্ধিকে প্রসারিত ও বিকশিত করে মনের ভেতরে আলো জ্বালাতে সাহায্য করে। বই-ই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যার সাথে পার্থিব কোনো সম্পদের তুলনা হতে পারে না। একদিন হয়তো পার্থিব যত সম্পদ আছে সব বিনষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু একটি ভালো বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনও নিঃশেষ হবে না, তা চিরকাল হƒদয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা আছে, আজ যারা সফলতার চরম শীর্ষে পৌঁছেছে তাদের সবারই বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে। বই পড়ার মধ্য দিয়ে তারা রোজ নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। বিল গেটস প্রতি বছর ৫০টি বই শেষ করেন।
একটা বই শুধু তথ্য দেয় না, প্রশ্ন দেয়, এবং নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের জ্ঞানের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। যত বেশি বই পড়া যাবে, তত বেশি জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। বইয়ের ভেতরে থাকে অজানা তথ্যের খাজানা। যখন আমরা বই পড়বো তখন বইটির ভেতরে থাকা নানা ধরনের তথ্যের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারবো। বই-ই পারে একজন মানুষকে যথার্থ জ্ঞানী বানাতে আর জ্ঞান সবসময় একজন মানুষকে সমৃদ্ধ করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে বই পড়ার অভ্যাস মানুষকে ‘উবসবহঃরধ’ এবং ‘অষুযবরসবৎ’ং’ নামে দুটি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বই পড়ার ফলে মানুষের মস্তিষ্কে যে উদ্দীপনা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় তা মানুষের মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। শরীর সুস্থ রাখতে আমরা যেমন ব্যায়াম করি তেমনি মস্তিষ্ককে সবল ও কর্মচঞ্চল রাখতে বই পড়া বিশেষ জরুরি।
জনাথান সুইফট বলেছেন, ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান’। পড়ার সময় পাঠকের মস্তিষ্ক ভিন্ন জগতে বিচরণ করে এবং পঠিতব্য বিষয়ের প্রতি সে মনোনিবেশ করতে পারে। এভাবে বইয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নানাবিধ বিচরণের কারণে পাঠকের মানসিক চর্চা বৃদ্ধি পায়। বই পড়লে পাঠকের মানসিক চাপ হ্রাস পায়। অনেকে তাদের মানসিক চাপ কমাতে ব্যায়ামের আশ্রয় নেয়, কেউ কেউ আবার যোগব্যায়াম করে থাকেন। কিন্তু মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভালো বই পাঠ করলে তারা মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন করতে পারেন। বই পড়ার মধ্য দিয়ে আমরা এক মুহূর্তে কোনো এক অজানা জগতে পৌঁছাতে পারি। যা আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা, সমাজ সংসারের নানা দুঃখ-কষ্ট থেকে একটু হলেও রেহাই দেয়, ফলে আমাদের মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’
নেপোলিয়ন হিলের ২৩৮ পৃষ্ঠার ‘থিন্ক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ বইটি নানা গবেষণা করে লেখা শেষ করতে লেখকের সময় লেগেছে ২০ বছর এবং ভিক্টোর হুগো রচিত ‘লা মিজারেবল’ সর্বকালের অন্যতম সেরা উপন্যাসটির লেখার কাজ সম্পূর্ণ করতে টানা ১২ বছর সময় লেগেছিল। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮০। একজন মানুষের স্বাভাবিক বই পড়ার গতি যদি ২৫০ ঢ়িস হয় তাহলে প্রথম বইটি পড়ে শেষ করতে সময় লাগবে ৬ ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বইটি পড়তে সময় লাগবে ২ ঘণ্টা ১ মিনিট। তাহলে দেখা যায় ২০ এবং ১২ বছরের অভিজ্ঞতা আমরা মাত্র কয়েক ঘণ্টায় জানতে পারছি। এ থেকেই উপলব্ধি করা যায় বই পড়া কেন জরুরি।
বিভিন্ন বইয়ে লেখক তার জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই ব্যর্থতা তিনি কীভাবে কাটিয়ে উঠেন, সেই বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ থাকে বইয়ে। সেই লেখা বা গল্প থেকে জানতে পারা যায় কোন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করলে সফলতা নিশ্চিত হয় এবং ভুলের সম্ভাবনাও কমে আসে। বই নতুনভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ও মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে উপযোগী করে গড়ে তোলে। অস্কার ওয়াইল্ড তাই বলেছেন ‘আপনি আজ যা পড়েন, আগামীকাল তা হয়ে উঠবেন।’ বই আমাদের স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। আমরা যখন কোনো বই পড়ি তখন বইয়ের ভেতরে থাকা অগণিত তথ্যগুলো মনে রাখতে হয়। যেমন কোনো উপন্যাস, তা সেটা প্রেমেরই হোক বা ঐতিহাসিক কিংবা রাজনৈতিক কিংবা গোয়েন্দা সিরিজ অথবা কারো অটোবায়োগ্রাফি আমাদের কিন্তু সেই উপন্যাস কিংবা গল্পের চরিত্রের নাম, ইতিহাস, স্থান, উপন্যাসের উদ্দেশ্য, প্লট, উপকাহিনী সবটাই মনে রাখতে হয়। নাহলে গল্প বোঝা যায় না। যখন আমরা এসব তথ্য মনে রাখার কাজ করি তখন আমাদের মস্তিষ্কের অনেক ব্যায়াম হয়, যার ফলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও বই আমাদের মস্তিষ্কের নতুন নতুন কানেকশন তৈরি করে, ফলে আমাদের নতুন করে জানার আগ্রহ, মনে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
বই পড়লে শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। যত বেশি বই পড়া হয়, তত বেশি শব্দভাণ্ডারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ যোগ হতে থাকে। ফলে বই পড়া শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করে। লেখক যখন বই লেখেন তিনি অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে থাকেন, শব্দ নিয়েও তার গবেষণা কম থাকে না। আর আমরা বই পড়ার মাধ্যমে সেই শব্দগুলো সহজেই শিখে নিতে পারি। আর যে ব্যক্তি অনেক বই পড়ে থাকেন তিনি খুব সহজেই অন্যের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এতে ব্যক্তিজীবন উন্নত হয় এবং আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়। নতুন কোনো ভাষা শিখতেও বই পড়ার বিকল্প নেই।
যেহেতু বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়, সেহেতু বই-ই হতে পারে আমাদের জীবনের একনিষ্ঠ বন্ধু এবং বই পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের গতিপথ বদলাতে পারি এবং উঠতে পারি উন্নতির চরম শিখরে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা আমাদের জীবনে উন্নতি, শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে সাহায্য করে তাই, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বই পড়াকে একটি অপরিহার্য অভ্যাস হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
লেখক: শিক্ষার্থী
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments