Image description

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে, দীর্ঘ দেড় দশক পর, ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি ও পররাষ্ট্র নীতির গতিপথ ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। অভাবনীয় এই পরিবর্তন ভূ-রাজনীতিতে নতুন বলয় সৃষ্টি করেছে। এক নিমিষেই বন্ধু শত্রুতে এবং শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। আর এই মাত্রা এঁকে দিয়েছে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন। পুরাতন বলয় ধসে দিয়ে গড়ে তুলতে শুরু করেছে নতুন এক বলয়। আর এই বলয়ের তিন মহারথী চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।  

সম্পর্কের গণেশ উল্টোনোতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কেননা প্রচেষ্টা আগে থেকেই ছিল। বলা চলে সফল হতে বেশ সময় লাগলো। বঙ্গে ভারত বিরোধিতাও নতুন কিছু নয়। এটা যুদ্ধের সময়ও জারি ছিল। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন পিন্ডির পিঞ্জর ভেঙেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি বলে দিয়েছে, কেন তারা মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল। সেই অভিযোগের তীরও ওই ভারতের দিকেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত সহায়তাকে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের প্রতিশোধ বলে মনে করেন এই প্রজন্মের অনেকেই। যদিও এই প্রসঙ্গগুলো স্বাধীন দেশের জন্য কতখানি সম্মানজনক তা আলোচনা সাপেক্ষ। 

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে প্রবাহমান স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটছে। সেই ক্ষেত্রে বন্ধু শত্রু হয়েছে, শত্রু বন্ধু হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ তাদের হারিয়ে যাওয়া ভাই। একটা স্বাধীন দেশ সম্পর্কে, পরাজিত দেশের মানসিক প্রবৃত্তি, কোন পর্যায়ে থাকলে, এ ধরনের মন্তব্য করা যায়, তা সহজেই অনুমেয়। তারপরও বলতে হয় রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনআকাক্সক্ষার পালস বুঝে সরাসরি ভারত বিরোধিতায় মালকোঁচা দিয়ে নেমেছেন। এই ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি অত্যন্ত সরল। তিনি খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তাকে নিয়োগ দিয়েছে। আর এই ছাত্ররাই ভারতের অনুগত সরকারকে হটিয়ে ইউনূস সরকারের গোড়াপত্তন করেছে।

ভারতবিরোধী ইজমকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার পাকিস্তান ও চীনের সাথে দহরম-মহরম বাড়িয়েছে। এতে করে একঢিলে একাধিক পাখি শিকার হচ্ছে। চীনের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ও স্বাধীনতা পরবর্তী এই প্রথম পাকিস্তানের সাথে খুল্লাম-খোলা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে দেশের একটা বৃহৎ অংশ মহান মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে ভুল প্রমাণ করতে চাইছে। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পরে, এই প্রথম সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা অনেকটাই সফল বলা যায়। 

বাংলাদেশ শুরু থেকেই দুটি দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে অনীহা দেখিয়ে আসছে। একটি ইসরায়েল। যারা ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। আর একটা পাকিস্তান। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা ও ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে। যে বিবেচনায় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করেনি, সেই একই বিবেচনা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য হবে না? তারমানে কি? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ভুল ছিল? ৫৪ বছর পরে বাংলাদেশ সেই ভুলের কাফফারা দিচ্ছে। নাকি এরমধ্যে অন্য কোনো হীন উদ্দেশ্য নিহিত আছে? যা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কাজে লাগাচ্ছে ভারত। সেখানে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ ছোট-বড় মাঝারি মানের রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সাধারণ মানুষের বাংলাদেশ বিরোধী মনোগ্নীতে ঘি ঢালছে। এই মুহূর্তে কোন দল কত বড় বাংলাদেশ বিরোধী, তা প্রমাণে মরিয়া। এর কারণ অবশ্য ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন। যদিও এইক্ষেত্রে তথ্যের অতিপ্রচার রয়েছে। ঘটনা কিছু ঘটেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে সেই ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করাও ভারতে বাংলাদেশ বিদ্বেষের কারণ বলে মনে করা হয়। আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের সিমান্ত ঘেঁষা এলকাগুলোর ভোট টানতে এটা বড় কৌশল হিসেবে কাজ করবে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও শাসক প্রত্যাশী বাংলাদেশ বিরোধী জুজুর ভয় দেখিয়ে ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোট টানার চেষ্টা করছে।

সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির কথাবার্তা হাবভাব বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান বৈরী সম্পর্ককে আরও বৈরী করে তুলবে এটা সুস্পষ্ট। সেভেন সিস্টার্স দখল, হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সীমানার আকাশকুসুম কল্পনা। এসবই বালকোচিত চিন্তার প্রতিফলন। মোদ্দাকথা হচ্ছে, হয় ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো ভারতকে বয়কট করে তার বিকল্প খুঁজতে হবে। তবে তা সহসাই সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া ভারত যেমন সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হবে না। তেমনি অন্তর্বর্তী সরকার ভারত বিরোধী মনোভাবকে জিইয়ে রেখে ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চাইছে কিনা! এই শঙ্কাও থেকে যায়। রাজ কর্তাদের রাজ খেলায় বলি হবে দু-দেশের সাধারণ মানুষ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে উলুখাগড়ার প্রাণ যাবে।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকানে সামরিক বাহিনীর অভিযানে বাস্তুচ্যুত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে সদ্য বিলুপ্ত সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে। সেই সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনায় ও মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়াকে ভুল বলা যাবে না। দেশের মানুষের মানবিক আবেগকে সরকার উপেক্ষা করতে পারেনি।

বর্তমানে রোহিঙ্গা আসার স্রোত কমলেও থেমে যায়নি। সামনে এই স্রোত বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলে নিচ্ছে। জান্তা সরকার পিঠ বাঁচাতে রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেসামরিক লোককে প্রলোভন দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করছে। যেকোন সময় আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করতে পারে। আর তা ঘটলে ভারত ও চীনের কিছুই হবে না। বেকায়দায় পড়বে বাংলাদেশ। পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হবে, তেমনই রোহিঙ্গা প্রবেশের স্রোত ঠেকানো কঠিন হবে।

চীন ও ভারত তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য কায়েম করতে নতুন নতুন বিনিয়োগের পসরা সাজিয়ে এগোচ্ছে আরাকানের পানে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রেখে আসা ভূমিতে গড়ে তুলছে নতুন অবকাঠামো। এদিকে বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর আলাপে বিশ্ব মোড়লদের সাড়া মিলছে না। যেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মহা ভুল করেছে। আর আজ সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ১৮ কোটি নাগরিককে। অপরদিকে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের নিত্য নতুন অপরাধ প্রবণতা ও অনিয়ন্ত্রিত জš§হার। খুন, রাহাজানি থেকে হেন কুকর্ম নেই যা রোহিঙ্গারা করছে না। অতিরিক্ত জনসংখ্যার পুনর্বাসনে প্রতিনিয়ত পাহাড়, টিলা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সাথে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের হরেকরকম সংস্কারের কথা বললেও রোহিঙ্গা বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। জানি না কুলুপ আঁটার অদৃশ্য কোনো কারণ আছে কি-না। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে আর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর নিত্যপণ্যের জন্য ভারতই শেষ ভরসা। এত এত বাদানুবাদের পরও ভারত থেকে প্রতিনিয়ত চাল, ডাল, তেল পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এটাই বাস্তবতা। বিকল্প বলয় তৈরি করলেও সেখানে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আমদানি-রপ্তানি করার ক্ষেত্র গড়ে উঠেনি।
ভৌগোলিক কারণে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জো নাই। যদিও চীন ভারতের বিকল্প হওয়ার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে কতখানি সফল হবে তা সময় বলে দেবে। আবার দেশের মানুষ বিষয়টিকে কীভাবে নিবে সেটাও বিবেচনার বিষয়। কারণ ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত অনেক নৈকট্য।

বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যান্ড। এর একমাত্র কারণ দেশের দক্ষিণ অংশ জুড়ে রয়েছে বিশালাকার বঙ্গোপসাগর। যার পানে পরাশক্তিদের লোভাতুর দৃষ্টি রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নজরদারি বাড়াতে। আর এই উদ্দেশ্য সাধনে বঙ্গোপসাগরই হতে পারে সার্চ পয়েন্ট। এখানে নৌঘাঁটি স্থাপন করে দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্র উপকূলীয় দেশসমূহে নজরদারি করতে চায়। এই চেষ্টা তাদের পুরাতন। এক্ষেত্রে চীন তাদের একমাত্র বাঁধা। কারণ চীন এই অঞ্চলে অতি মার্কিন আধিপত্যকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের হুমকি হিসেবে দেখে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে মার্কিনিদের অতি নাক গলানোকে ভালো চোখে দেখবে না কমিউনিস্ট প্রশাসন। তবে ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত মোদির ঘাড়ে বন্দুক রেখে কাজের কাজটি সারতে চায়। সেক্ষেত্রে ভারতও দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিতে মার্কিন পরাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে চীনকে দমিয়ে রাখার কৌশল নিতে পারে।

মার্কিনের পুনঃনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রমাণিত বন্ধু। বাংলাদেশের বর্তমান আন্তবর্তীকালিন সরকারের সাথে তাদের দুজনেরই সম্পর্ক কিছুটা বৈরী। এই বৈরিতাকে কাজে লাগিয়ে ভারত বাংলাদেশে অনাধিকার চর্চা করে কি-না সেই শঙ্কাও থেকে যায়। অপরদিকে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিনদেশ রচিত নতুন বলয় এই অঞ্চলে ভারতের আগ্রাসী আধিপত্যকে ঠেকিয়ে দিতে মোটামুটি একাট্টা। ভারত অবশ্য এ অঞ্চলে অনেকটাই বেওয়ারিশ।

প্রতিবেশী মিত্রদের সাথে অতি আধিপত্য দেখাতে গিয়ে সকলের সাথেই সম্পর্কের পারদ মাইনাস ফিগারে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কোন সরকার ভারত পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে এইভাবে সরাসরি চ্যালেঞ্জে যায়নি। বর্তমান আন্তবর্তী সরকার সেই দুঃসাহসটি দেখিয়েছে। সরকার প্রধান ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। তার ফেসভ্যালু অনেক। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন বলয় রচনা করে তিনি বাঙালি জাতিকে কতদূর এগিয়ে নিতে পারেন। এটাই দেখার অপেক্ষায় বাংলাদেশ। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি