Image description

বর্ষার মৌসুম মানেই রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের শঙ্কা। যেন এক আতঙ্কের নাম বৃষ্টি। গত কয়েকদিন ধরে পাহাড়ি জেলা রাঙ্গামাটিতে থেমে থেমে ছোট, মাঝারি ও ভারি বর্ষণ হচ্ছে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের পর রাঙ্গামাটিতে বৃষ্টি শুরু হলেই প্রতি বছরই পাহাড় ধসে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু এড়াতে শুরু হয় মাইকিংসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি। কিন্তু তা কেনো কাজেই আসছে না। মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও এক শ্রেণির মানুষ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে তুলছে নতুন নতুন বসতি। ‘মৃত্যুকূপে’ বসবাস করছে ৬ হাজার পরিবার।

এদিকে পাহাড়ে থেমে থেমে ভারি বর্ষণ চলমান রয়েছে। রাঙ্গামাটি আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যাবেক্ষক ক্যাসিনো মারমা জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, প্রশাসনের নজরদারি অভাবে পাহাড়ের পাদদেশে অনায়সে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতি এবং তারা মৃত্যুও ঝুঁকি জেনেও বসবাস করছেন। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে স্বল্প সময়ের জন্য প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কর্তৃপক্ষ ঢাকঢোল পিটিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেই দায়িত্ব শেষ করে। ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টিপাতজনিত কারণে ২০১৭ সালের মতো আরও একটি বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। এ অবস্থায় ‘মৃত্যুকূপে’ বসবাসকারীদের সেখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও পুনর্বাসন করার দাবি জানান সচেতন ব্যক্তিরা।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, রাঙ্গামাটিসহ ১০টি উপজেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং উপজেলা পর্যায়েও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নিকটবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাঙ্গামাটি পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ২৩টি আশ্রয়কেন্দ্র সহ মোট রাঙ্গামাটি জেলায় ২৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় প্রায় ২৫০টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে। এতে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার পরিবার। ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে ৬টি টিম প্রতিনিয়ত মাইকিং করছেন। এতে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটগণ এক সাথে কাজ করছেন। তবে এখনো পর্যন্ত কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে আসেননি।

ভেদভেদী শিমুলতলী এলাকার বাসিন্দা মো. শামিম জানান, ২০১৭ সালে যখন পাহাড় ধস হয়, তখন তিনি পরিবার নিয়ে প্রায় ৬ মাস আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মৃত্যুও ঝুঁকি জেনে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন তিনি। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তবে সবারই তো জীবনের নিরাপত্তা দরকার। নিরুপায় হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। সরকার নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করলে চলে যাব।

একই এলাকার বাসিন্দা মো. সোহেল জানান, রাঙ্গামাটিতে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এখানে রাত হলেই চুরি হয়। এখানকার পরিবারগুলো গরীব। তাই চুরি ভয়ে তারা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাই না।

রূপনগর এলাকার বাসিন্দা মো. সাকিব হোসেন জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নিরাপদ স্থানে বা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাবো।

একই এলাকার আরেক বাসিন্দা আকবর জানান, বর্ষা মৌসুমে জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চিহ্ন দিয়ে চলে যান। পাহাড়কে ঝুঁকিমুক্ত করে বসবাসের উপযোগী করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ভেদভেদী পশ্চিম মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা আবুল বাশার জানান, তারা এখানে নিরাপদে আছেন। যদি বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হয়,তাহলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাবেন।

রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানান, পাহাড় ধস মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরে যেতে প্রতিনিয়িত মাইকিংও করা হচ্ছে। যারা পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস করছে তাদের ঝুঝিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে আসা হচ্ছে এবং আশ্রয়কেন্দ্র থাকা মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। 

তিনি আরো জানান, জেলার প্রতিটি উপজেলায় একইভাবে কাজ করা হচ্ছে।এতে সহযোগিতা করছেন,স্বেচ্ছাসেবী,রেডক্রিসেন্ট এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পাহাড় ধসের মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সর্তক আছেন বলে তিনি জানান।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের (১৩ জুন) প্রবল বর্ষণে ভয়াবহ পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটিতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এতে দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। ব্যাপক ক্ষতি হয় পুরো জেলায়। ফলে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাঙ্গামাটি জেলা। তিন মাস আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিলেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। পরের বছর ২০১৮ সালে একই সময়ে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় প্রবল বর্ষণে মৃত্যু হয় ১১ জনের। এছাড়াও ২০১৯ সালে পাহাড় ধসে কাপ্তাই উপজেলায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছিল। বারবার এত হতাহতের পরও থেমে নেই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস।