জুড়ীর পাহাড়ি বনে নিঃশব্দে চলছে বাঁশ লুটের উৎসব
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পাহাড়ি বনাঞ্চলে চলছে নিঃশব্দ লুটের মহোৎসব। জুড়ী রেঞ্জের ৭টি বাঁশমহাল দীর্ঘদিন ধরে ইজারাবিহীন থাকায় সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। রাতের আঁধারে নির্বিচারে কেটে নেওয়া হচ্ছে বনের মূল্যবান বাঁশ ও বেত। এরপর সেই বাঁশ ছড়ার পানিতে ভাসিয়ে পাচার করা হচ্ছে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
একসময় এসব বাঁশমহাল থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতো কোটি টাকা। কিন্তু এখন দরপত্র আহ্বান করেও কোনো ইজারাদার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে রাজস্ব আয় যেমন শূন্য, তেমনি পুরো বনাঞ্চল এখন চোরাকারবারিদের দখলে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার চারটি রেঞ্জে মোট ২৩টি বাঁশমহাল রয়েছে এর মধ্যে রাজকান্দি ও জুড়ী রেঞ্জে ৭টি করে, বড়লেখায় ৪টি এবং কুলাউড়া রেঞ্জে ৫টি। প্রায় ৪০ হাজার ৫৫ একর বনভূমি এসব মহালের আওতায়।
গত ২০ এপ্রিল সিলেট বন বিভাগ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাঁশমহালগুলোর দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু কোনো নিবন্ধিত মহালদার দরপত্রে অংশ নেননি। ফলে সরকারিভাবে এসব মহাল এখন শূন্য থাকলেও বাস্তবে সেখানে চলছে অবাধ লুটপাট।
জুড়ী রেঞ্জের সুরমাছড়া, রাগনাছড়া, পুটিছড়া, পূর্ব গোয়ালী, ধলাইছড়া, সাগরনাল ও হলম্পাছড়া বাঁশমহালে সরেজমিনে দেখা গেছে—সবখানেই বাঁশ কেটে ফেলার চিহ্ন। কোথাও পড়ে আছে গোঁড়া, কোথাও ফাঁকা টিলা, আবার কোথাও আগুনে পুড়ে যাওয়া ধোঁয়াটে পাহাড়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এসব বাঁশমহাল থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার বাঁশ কেটে পাচার করা হচ্ছে। বনাঞ্চলের ভেতরে হওয়ায় সাধারণ মানুষের চলাচল একেবারেই কম—এই সুযোগেই রাতের আঁধারে বাঁশ কেটে ছড়ার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় চোরাকারবারিরা।
সাবেক এক ইজারাদার জানান, “আমরা বাজারে একটি বাঁশ বিক্রি করি ২০ টাকায়, কিন্তু সরকারের দরপত্রে নির্ধারিত মূল্য তার চেয়েও বেশি। এতে লাভ তো হয়ই না, উল্টো লোকসান গুনতে হয়। এজন্য কেউ আর ইজারা নিতে চায় না।”
তাদের অভিযোগ, কিছু অসাধু মহালদার ও বন বিভাগের কর্মকর্তা মিলে অতিরিক্ত দর দেখিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়া জটিল করে তুলেছেন, যার ফলে নতুন মহালদাররা আগ্রহ হারাচ্ছেন।
চোরাকারবারিরা শুধু বাঁশ কাটায় সীমাবদ্ধ থাকছে না; চুরির আলামত মুছে ফেলতে মাঝে মাঝে তারা বনেও আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে যেমন প্রমাণ ধ্বংস হয়, তেমনি ছাই হয়ে যায় বনের জীববৈচিত্র্য।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের সমনবাগ বিটে দেখা যায় ভয়াবহ চিত্র। কোটি টাকার বাঁশ উজাড় করার পর আগুন লাগানো হয় পুরো বনে।
এতে ধলছড়ি, মাকালজোরা ও আলামবাড়ি এলাকার অন্তত ৪০ হেক্টর বনভূমি পুড়ে যায়। বন বিভাগের তথ্যমতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হেক্টর, কিন্তু স্থানীয়দের ভাষ্যমতে অন্তত ১২টি টিলা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারীর সহায়তায় রাতের আঁধারে বাঁশ কেটে নেওয়া হয় এবং প্রমাণ মুছে ফেলতে আগুন লাগানো হয়। ফলে একসময় বন্য হাতির আশ্রয়স্থল এই বন এখন পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে।
জুড়ী বাজারের বাঁশ বিক্রেতা বিল্লাল হোসেন বলেন, “আমরা প্রতিদিন বাজারে বাঁশ বিক্রি করি, কিন্তু মহাল থেকে বাঁশ কিনতে পারি না। বড় বড় ব্যবসায়ীরাই লুটে নিচ্ছে সব। বন বিভাগের নজরদারি না থাকায় তারা বিনা বাধায় পাচার করছে।”
পরিবেশকর্মী খোরশেদ আলম বলেন, “মৌলভীবাজারে একসময় প্রাকৃতিক বাঁশবন ছিল দেশের অন্যতম সরবরাহ কেন্দ্র। আজ সেই বন ধ্বংসের মুখে, চোরাকারবারি আর অব্যবস্থাপনায়।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলার সভাপতি সালেহ সোহেল বলেন, “ইজারা প্রথা বাঁশবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। এখন সময় এসেছে ইজারা প্রথা বন্ধ করে প্রাকৃতিক বনায়নের আওতায় বাঁশ সংরক্ষণের। বাঁশকে রাজস্ব নয়, বনের সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে।”
মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন, “বাঁশমহাল শুধু রাজস্বের উৎস নয়, এটি পাহাড়ি জীববৈচিত্র্যের অংশ। প্রশাসনের দুর্বলতা ও বন বিভাগের উদাসীনতায় এই বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখনই কার্যকর নজরদারি না আনলে বাঁশবন কাগজে-কলমেই টিকে থাকবে।”
এ বিষয়ে সিলেট বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. নাজমুল আলম বলেন, “ইজারা না হওয়ার পেছনে কিছু প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতা রয়েছে। প্রতিটি মহালের বাঁশের পরিমাণ ও পুনর্জন্ম ক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য একটি টিম মাঠে কাজ করছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর টেকসইভাবে যেসব মহাল ইজারা দেওয়া সম্ভব, সেখানে দরপত্র আহ্বান করা হবে। অবৈধভাবে বাঁশ কাটা বা পাচারের বিষয়ে নিয়মিত অভিযানও চলছে।”




Comments