ইন্দুরকানীতে ভারত ও সৌদি প্রবাসীর নামে ভিজিডি'র কার্ড
পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার পশ্চিম বালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পান্না মৃধা দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী মোছা. আকলিমা বেগমকে নিয়ে ভারতে বসবাস করছেন। অথচ বাংলাদেশে সরকারি নারী কল্যাণমূলক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির (ভিডব্লিউবি) আওতায় তার নামে চলছে ভালনারেবল গ্রুপ ডেভলপমেন্ট বা ভিজিডি কার্ড। তবে এই কার্ডের মাধ্যমে দুস্থ নারীদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আকলিমা বেগম বা তার পরিবারের কেউ পাচ্ছেন না।
এদিকে একই উপজেলার বালিপাড়া গ্রামের মো: জাহাঙ্গীর শেখ এর মেয়ে জাকিয়া আক্তার রিমা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে বসবাস করছেন। রিমার নামেও চলছে ভিজিডি কার্ড। তবে এই কার্ডের মাধ্যমে দুস্থ নারীদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত চাল থাকলেও এই চাল পাচ্ছেন তার পরিবার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আকলিমা বেগম বছরের পর বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। তবুও তার নামে সরকারি সহায়তার কার্ড করে সেই কার্ডের চাল আত্মসাৎ করছেন বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বাবুল। এছাড়া জাকিয়া আক্তার রিমা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে থাকলেও সরকারি সহায়তার এ চাল পাচ্ছে তার পরিবার।
গ্রামবাসীর দাবি, শুধু আকলিমা বেগম নয় এরকম অনেকেরই নামে কার্ড হয়েছে কিন্তু তারা বিজিডি চাল পাচ্ছেন না এবং কেহ আবার সৌদি আরবে থাকলেও চাল পাচ্ছে তার পরিবার। ভিজিডি কার্ডের তালিকা প্রণয়নের সময় প্রকৃত দুস্থ নারীদের নাম দেওয়া হলেও কার্ড দেওয়া হয়েছে ভিন্ন কাউকে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও তদন্ত দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে খোঁজ নিতে সরেজমিনে আকলিমা বেগমের বাড়িতে গেলে জানা যায়, তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে বসবাস করছেন। সেখানে তাদের একটি দোকান আছে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে।
এ ব্যাপারে জানতে তার মুঠোফোন নম্বরটি সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে আকলিমা বেগম বলেন, আমি কার্ড পাওয়ার বিষয়ে কিছুই জানিনা। আমি দশ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে আছি। আমার কার্ড কারা কিভাবে করেছে জানি না। তবে কার্ডটি আমার না হয়ে আমার ওখানকার পরিবারের লোকদের নামে হলে ভালো হতো তারা অন্তত এসব সুবিধা পেত।
বালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ভিজিডি কার্ডধারী সৌদি প্রবাসী জাকিয়া আক্তার রিমার পরিবারের মোবাইল নাম্বারটি সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে তার মা মুঠোফোনে জানান, আমার মেয়ে প্রবাসে থাকে। সে জন্য আমি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চাল আনি। তবে পরে আবার তার মেয়ে অসুস্থতার কথাও জানান তিনি। এসময় তাকে আরও কিছু প্রশ্ন করা হলে, উত্তর না দিয়ে কলটি কেটে দেয়।
খোজ নিয়ে জানা যায়, বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভিডব্লিউবি মহিলা বাছাই কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিব স্বাক্ষরিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভিডব্লিউবি কর্মসূচির জন্য উপকারভোগী মহিলা নির্বাচন করে তাদের জন্য ২২৬ টি কার্ড অনুমোদন হয়। যেখানে তালিকার চূড়ান্ত ছকে আকলিমা বেগমসহ উপজেলার ঢেপসাবুনিয়া গ্রামের আশ্রাব আলী ফরাজীর মেয়ে মিতু আক্তার, পশ্চিম বালিপাড়া গ্রামের মো. ইলিয়াস হাওলাদারের স্ত্রী রাশিদা বেগম ও বালিপাড়া গ্রামের মাসুম সেপাইয়ের স্ত্রী মোসা: সুরিয়া বেগমের নাম পাওয়া যায়, যারা ভিজিডি কার্ড কিংবা চাল কোনটাই পায়নি।
এ বিষয়ে ঢেবসাবুনিয়া গ্রামের মিতু আক্তারের পিতা আশ্রাব আলী ফরাজী বলেন, আমি ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। আমার একপায়ে সমস্যা আছে। এই বয়সে ভ্যান চালাতে খুব কষ্ট হয়। গরিব মানুষ তাই কষ্ট করে ভ্যান চালিয়ে খাই। আমার মেয়ের নামে একটি ৩০ কেজি চালের কার্ড হয়েছিল কার্ডটি আমাকে দেয়নি। আমাদের চেয়াম্যান বলেছেন কার্ড তোমাকে দিতে পারি যদি অর্ধেক চাল অন্য একজনকে ভাগ দিতে পারো। আমি যদি কার্ডটি পাই তাহলে আমার খুব উপকার হয়।
পশ্চিম বালিপাড়া গ্রামের মো. ইলিয়াস হাওলাদারের স্ত্রী রাশিদা বেগম বলেন, আমার একটি কার্ড হয়েছিল কিন্তু সেই কার্ডটি আমাকে দিয়ে আবার জোড় করে নিয়ে গেছে। আমি খুব অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছি।
বালিপাড়া গ্রামের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মামুন সেপাই বলেন, আমি ভিজিডির তালিকার লিস্টে দেখেছি আমার ভাই মাসুম সেপাইয়ের স্ত্রী আমার ভাবি সুরিয়া বেগমের নামে একটি ভিজিডি কার্ড হয়েছে। তবে সে এখন পর্যন্ত কার্ড বা চাল কিছুই পায়নি।
এ বিষয়ে বালিপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মো: নাসির উদ্দীন সেন্টু বলেন, আমি ভিজিডির কোনো কার্ড আটকিয়ে রাখিনি, এটা সম্পূর্ণ চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণে হয়।
এছাড়াও ইন্দুরকানী সাব রেজিস্ট্রার অফিসের নিয়ম অনুযায়ী অর্থ বছরের জমি রেজিষ্ট্রেশনের ফি থেকে ১ পার্সেন্ট টাকা উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বরাদ্দকৃত ৪ লাখ টাকা পরিষদের নিজস্ব ব্যাংক একাউন্টে আসার কথা থাকলেও ওই টাকা আসেনি। তবে পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বাবুল এর নিজস্ব ব্যাংক একাউন্টে ওই টাকা চলতি বছরের ২৩ মার্চ চেকের মাধ্যমে জমা হয়েছে। বরাদ্দকৃত ১ পার্সেন্ট এর ওই টাকা দিয়ে এলাকায় উন্নয়ন মূলক কাজ করার নিয়ম থাকলেও এখনো কোনো কাজের ভাউচার পরিষদে জমা হয়নি।
এদিকে এসব বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
৩ নং বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সচিব) কবিরুল ইসলাম বলেন, ভিজিডি কার্ডের জন্য চেয়ারম্যান ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নারীদের নির্বাচন করে আমাকে দিয়েছে। উপকারভোগী নারী নির্বাচনে আমার কোন ভুমিকা ছিলনা। তবে যে নারীর নামে কার্ড হবে সে নিজে উপস্থিত হয়ে চাল নিবে। অন্য কাউকে চাল দেয়ার নিয়ম নেই। এছাড়া ১ পার্সেন্টের ৪ লাখ টাকা পরিষদের একাউন্টে আসেনি এবং এই টাকার কোনো কাজ হয়েছে কিনা তা জানিনা, এর কোনো ভাউচারও জমা হয়নি।
বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বাবুল বলেন, উপকারভোগী মহিলা নির্বাচন করে যাচাই-বাছাই আমরা করিনি যাচাই-বাছাই সব সচিব করেছেন। তবে ১ পার্সেন্টের টাকা পরিষদের একাউন্ট অথবা চেয়ারম্যানের একাউন্টের যে কোনো একটিতে জমা হতে পারে। এই টাকার কিছু কাজ হয়েছে, আর কিছু কাজ বাকি আছে। অন্য আরও কয়েকটি প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান।
সার্বিক বিষয়ে ইন্দুরকানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাসান বিন মুহাম্মাদ আলী বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত এমন কোন অভিযোগ পাইনি। ঘটনার সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।




Comments