Image description

আজ ৮ ডিসেম্বর সোমবারগৌরীপুুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাতের আঁধারে পাক হানাদার বাহিনী গৌরীপুর ছেড়ে চলে গেলে শত্রুমুক্ত হয় গৌরীপুর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণের পর থেকেই শুরু হয় গৌরীপুরে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়া। 

২৬ মার্চের পর এপ্রিলের প্রথম দিকে গৌরীপুরে শুরু হয় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম পর্যায়ের সংগ্রাম। তৎকালীন এমসিএ মরহুম হাতেম আলী মিয়া ও গৌরীপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আলী হাসানের তত্ত্বাবধানে ১৭টি রাইফেল নিয়ে শুরু হয় স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষন। তাঁদেরকে সহযোগিতা করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মোঃ মমতাজ উদ্দিন ও আক্কাছ আলী।

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ থেকে রেলপথে পাক হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে প্রবেশ করেই হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। ওই দিন সকাল থেকেই পাকিস্থানী জঙ্গি বিমান গৌরীপুরের আকাশে টহল দিয়ে থেমে থেমে আকাশ থেকে রেলস্টেশন, কলেজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা লক্ষ করে গুলিবর্ষন করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুর শহরে প্রবেশ করেই কালীপুর মোড়ে গুলি করে হত্যা করে স্কুলশিক্ষক ব্রজেন বিশ্বাসকে।

হানাদার বাহিনী গৌরীপুর দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যায়। এসময় একে একে সবাই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিব বাড়ীতে আশ্রয় নেন এবং ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। এদিকে গৌরীপুরে পাক হানাদার বাহিনী সাধারন মানুষের উপর চালায় নির্মম অত্যাচার। ১৬ মে সকালে হানাদার বাহিনী শালীহর গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যায় বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক মধু সুদন ধর এবং পৌর শহর থেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কৃষ্ণ সাহাকে। তাঁরা আজো ফিরে আসেনি।

আগস্ট মাসে গৌরীপুরে অবস্থানরত পাক বাহিনীর উপর হামলা শুরু করে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় তাঁরা হানাদারদের চলাফেরা ও যোগাযোগ ব্যর্থ করে দিতে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেলসেতু। অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করেন রেলস্টেশন ও পাটগুদাম।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলায় পাক বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং শালীহর গ্রামে প্রবেশ করে গণহত্যা চালায়। সেখানে ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল হাসেমের পিতা ছাবেদ হোসেনকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ৩০নভেম্বর পলাশকান্দায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন জসিম উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম মনজু ও মতিউর রহমান। শ্যামগঞ্জে শহীদ হন সুধীর বড়ুয়া।

অবশেষে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে গৌরীপুর শহর ছাড়া সমস্ত এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাক হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে শহর ছেড়ে রেলযোগে গৌরীপুর থেকে পালিয়ে যায়। ওই রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে আবুল কালাম আজাদ, আঃ হেকিম, নজরুল ইসলাম, সোহরাব, ছোট ফজলু, আনসার, কনুসহ একদল মুক্তিযোদ্ধার নিকট গৌরীপুর থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। এই খবর মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে শহরের মুক্তি পাগল জনতা জয় বাংলা ধ্বনিতে গৌরীপুরের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে এবং প্রানঢালা অভিনন্দন জানিয়ে বরণ করে নেন বাংলার দুর্জয় সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের।

মুক্তিযুদ্ধে গৌরীপুরে যাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম হাতেম আলী মিয়া (এমসিএ), মরহুম ডাঃ এম এ সোবহান, মরহুম মোঃ খালেদুজ্জামান, যুদ্ধকালীন ১১ নং সাব-সেক্টর কমান্ডার মরহুম তোফাজ্জল হোসেন চন্নু ও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মরহুম মজিবুর রহমানের নাম অন্যতম।

প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে।