Image description

পাইকগাছার খাল-বিল, ধানক্ষেত ও জলাশয়ে আইন অমান্য করে পাখি শিকার হচ্ছে প্রতিদিনই। অভিনব ফাঁদ, নকল ডাক ও বিষ মিশ্রিত খাদ্যের মাধ্যমে শত শত দেশি-বিদেশি পাখি নিধনের শিকার হচ্ছে। এলাকাবাসী দাবি করছেন—যদি প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করে, শীঘ্রই পাখির ডাক এখানকার আকাশে শোনা যাবে না।

শীতকালে শিকারিদের তৎপরতা বাড়লেও প্রশাসনের নজরদারি তেমন কার্যকর নয়। উপজেলার বিভিন্ন বিলে খুঁটি পুঁতে বিশাল কারেন্ট জাল টাঙিয়ে ভয়াবহ ফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে। সকাল হলে ঝুলতে দেখা যায় বালিহাঁস, সাদা বক, পানকৌড়ি, সরালী, শামুকখোলসহ নানা পাখির নিথর দেহ। বয়রা, কচুবুনিয়া, বাইসারাবাদ, তেঁতুলতলা, লতা, হানিমুনকিয়া, দেলুটি, সোলাদানা, খড়িয়া, চকবগুড়া, আমিরপুর, বাইনবাড়ীয়া, কুমখালী ও পৌরসভার বিলে একই চিত্র।

এলাকাবাসী জানান, “কখনো ফসলের ক্ষেতে, কখনো ঘেরের পাশে, আবার কখনো খালের ধারে জাল দেখে আমরা ভয় পাই। রাতে পাতা জালে সকালে মৃত পাখি স্তূপ করে থাকে।”

প্রচলিত ফাঁদের পাশাপাশি শিকারিরা নতুন কৌশলও অবলম্বন করছে। ইন্টারনেট থেকে পাখির ডাক রেকর্ড করে সাউন্ড বক্সে বাজিয়ে ফাঁদ পেতে বসে থাকে। নকল ডাক শুনে আশপাশের পরিযায়ী পাখি নিজেদের দলের অংশ মনে করে আসে এবং ফাঁদে ধরা পড়ে। এক স্থানীয় কৃষক বলেন, “এটা হত্যার চেয়ে ভয়ংকর। পাখির ডাক নকল করে তাদের প্রতারণা করা হচ্ছে; তারা নিরাপদ মনে করে আসে, আর মৃত্যুর মুখে পড়ে।”

শুধু জাল নয়, অনেক শিকারি মাছ, ব্যাঙ ও ফড়িং জাতীয় খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ফাঁদ পেতে রাখে। খাদ্যের জন্য আসা পাখিরা বিষ খেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মারা যায়। প্রতিদিন শত শত পাখি এভাবে নিধন হচ্ছে। বাজার, চা-দোকান ও ঘাটে দেখা যায় ৩০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় পাখি বিক্রি হচ্ছে। কেউ রসনার তৃপ্তির জন্য, কেউ শখে কিনে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশে প্রায় ৭৪০ প্রজাতির পাখি রয়েছে এবং বিশ্বে প্রায় ১০ হাজার। এদের অনেকেই শীতকালে পাইকগাছার মতো উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু নির্বিচারে শিকার, বিষ, শব্দদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখির অস্তিত্ব সংকটের মুখে। পরিবেশবিদদের মতে, “যে সমাজ তার পাখিদের রক্ষা করতে পারে না, সে সমাজ নিজের ভবিষ্যৎও রক্ষা করতে পারবে না।”

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী পাখি শিকার, হত্যা, বিক্রি বা পরিবহন সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাইকগাছায় আইন প্রয়োগ দুর্বল। দুই-একটি অভিযান হলেও শিকারিরা আগের চক্রে ফিরে আসে।

এলাকাবাসীর দাবি, “চাই নিয়মিত অভিযান, রাতের টহল, জাল জব্দ ও জরিমানা। না হলে আগামীতে পাখি আর দেখা যাবে না।”

নির্মল কুমার পাল, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (খুলনা) জানান, “আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা দ্রুত অভিযান পরিচালনা করতে পারব।”

পাখি বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। পাইকগাছার বিল, মাঠ ও জলাশয়—প্রতিটি পাখির মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির গল্প। আজ যদি আমরা তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হই, আগামী প্রজন্ম আর পাখির ডাক শুনে বড় হতে পারবে না। এখনই শিকার বন্ধে একসাথে দাঁড়ানোর সময়।