রাতভর ডিউটি শেষে ভোরে কারখানা থেকে বের হতেই দুই যুবককে ধরে এনে গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। চুরির অভিযোগ তুলে দিনভর রড, বাঁশ দিয়ে ধাপে ধাপে পেটানো হয়। এরপর তাদের চোখে, মুখে, সারা গায়ে লবণ ও মরিচের গুড়া ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আবদার গ্রামে অটোরিকশা চুরির অপবাদ দিয়ে দিনব্যাপী মধ্যযুগীয় কায়দায় দুই যুবককে এমন নির্যাতন করা হয়। এই ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ওই দুই যুবক ফের মারধরের আশঙ্কায় পুলিশের সহযোগিতা নিতেও সাহস পাচ্ছে না।
নির্যাতনের শিকার যুবক মো. আলমগীর হোসেন (২৪) শ্রীপুর উপজেলার আবদার গ্রামের আছিম উদ্দিনের ছেলে। অপর যুবক মাইনুদ্দিন সোহেল (২৬) ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার ভাতাদিয়া গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে। তারা দুজনই উপজেলার সাইটালিয়া গ্রামের ইরেক্টস্ পুলস অ্যান্ড স্টাকচারস্ লিমিটেডের শ্রমিক।
নির্যাতনের শিকার দুই যুবক ও তাদের স্বজনরা জানায়, গত ২৫ অক্টোবর ফাইজুদ্দিনের মালিকানাধীন অটোরিকশা চালককে নেশা জাতীয় খাবার খাইয়ে অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ফাইজুদ্দিন ও তাঁর চালক মঙ্গলবার ভোরে কারখানার সামনে থেকে চুরির অভিযোগে আলমগীর ও সোহেলকে আটক করে আবদার গ্রামে বাড়ির কাছে নিয়ে আসে। সকাল ৭টায় তাদের দুজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে চালানো হয় নির্যাতন। তাদের রড, রোল, বাঁশ, কাঠ দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। ধাপে ধাপে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলে এমন নির্মম নির্যাতন। এতে তাদের হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত ও ক্ষত হয়। মারধরের এক পর্যায়ে ফাইজুদ্দিনের স্ত্রী লিমা ওই দুই যুবকের চোখে-মুখে ঘর থেকে মরিচের গুড়া ও লবণ এনে ছিটিয়ে দেয়। ক্ষত স্থানেও দেয়া হয় মরিচের গুড়া ও লবণের ছিটা। এমন নির্যাতনের হতবাক এলাকাবাসী অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
অটোরিকশার মালিক ফাইজুদ্দিন বলেন, ‘গত শুক্রবার দুই যুবক আমার একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে কাওরাইদ, বরমী ও শ্রীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি করে। এক পর্যায়ে স্যালাইনে নেশা জাতীয় কোনো দ্রব্য খাওয়াইয়ে চালকের কাছ থেকে অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমি ওই অটোরিকশা উদ্ধারে চালককে নিয়ে বিভিন্ন জায়গাতে যাই। এক পর্যায়ে চালকই ওই দুজনকে শনাক্ত করে। পরে তাদের ধরে এনে এলাকার শত শত মানুষ মারধর করেছে। আমার কিছুই করার ছিল না।’
তাদের না পিটিয়ে পুলিশে কেন দিলেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ফাইজুদ্দিনের স্ত্রী বলেন, ‘চোরের শাস্তি পেটানো। দেখেন না কোথাও চোর ধরলে গণপিটুনি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। আমরা তো পিটিয়েছি মাত্র।’
নির্যাতনে যুবক আলমগীর গুরুতর আহত হওয়ায় কারখানার কাজে যোগ দিতে পারেননি। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত নিয়ে ঘরের মধ্যে শুয়েবসে সময় কাটছে তাঁর। আলমগীর বলেন, ‘আমি সোমবার রাতে কারখানায় ডিউটি করেছি। সকালে কারখানা থেকে বের হতেই তারা আমাকে আটক করে গাছের সাথে রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে ব্যাপক মারধর করেছে। আমাকে খুব পেটানো হয়েছে, আমি তাদের বারবার বলেছি “আমি অটোরিকশা চুরির বিষয়ে কিছুই জানি না”। তারা আমার কথা না শুনে পিটিয়েছে। এক পর্যায়ে আমার চোখ, মুখ ও শরীরের ক্ষত স্থানে মরিচের গুড়া ও লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
আলমগীর আরও বলেন, ‘তারা এলাকায় খুব প্রভাবশালী। অন্যায়ভাবে আমাদের পেটালেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলতে পারছে না। এখন থানায় গেলে আবার মারধর করতে পারে। এমন শঙ্কায় আমরা থানায় যেতে ভয় পাচ্ছি।’
শ্রীপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জয়নাল আবেদীন মন্ডল বলেন, ‘এ ঘটনায় এখনো কেউ থানায় আসেনি। লিখিত বা মৌখিক অভিযোগও জমা দেয়নি। নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে নির্যাতনের শিকার যুবককে সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
Comments