Image description

জীব মাত্রেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম আছে। সৃষ্টির সেরা জীব এবং দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে মানুষের একধাপ এগিয়ে স্বপ্ন দেখার বাধ্যবাধকতা আছে। এই স্বপ্ন যতোটা না কাকঘুম অবস্থায় দেখা, তার চেয়ে বেশি যে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত, সে ঘুমাতে পারে না। অর্থাৎ ব্যক্তি সমাজ ও দেশের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ। এই স্বপ্নকেই একাডেমিক ভাষায় প্ল্যান, পরিকল্পনা বা নিয়ত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, চাওয়া এবং পাওয়ার আকাক্সক্ষা অর্থনীতিতে বলে ডিমান্ড বাংলায় চাহিদা। 

চাইলেই পাওয়া যায় না, এই কারণেই চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যকার ব্যবধান আদিকালের, বাংলা ভাব-সম্প্রসারণে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় পরীক্ষায় পাসের জন্য, যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা চাই তাহা পাই না। তবে এরও ব্যতিক্রম আছে কারো কারো ক্ষেত্রে, যারা পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন, যথাযথভাবে কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম তাদের চাওয়ার চেয়ে পাওয়ার হিসাবও অনেক সময় বেশি হয়। এ নিয়মের ব্যতিক্রমীদের মধ্যে কাজ করে হতাশা, হতাশা দূরীকরণে দারস্থ হয় কপালের, ভাববাদীরা সান্ত¡না খোঁজে  যদি থাকে কপালে কি করবে গোপালে? এ ধরনের মহৌষধ নিয়ে? দর্শন, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অনুসারী মানুষের এ ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন দেখা সম্ভব না। এ ঘটনা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই কম-বেশি প্রযোজ্য। ড্রিম, প্ল্যান অ্যাকশন, ইভালুয়েশন আর মন-মগজে যুক্তিদর্শন বিজ্ঞান এবং আধুনিক  প্রযুক্তিই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। এ কাজগুলো করার জন্য প্রয়োজন আলোচনা সমালোচনা বর্জন ও গ্রহণের মানসিকতা, প্রয়োজন সমঝোতা, পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল স্তরে। গণতান্ত্রিকতা পরমতসহিঞ্চুতা ও ধৈর্য খুবই প্রয়োজন। ব্যর্থতার হতাশা কাটাতে আত্মতুষ্টির ভাববাদী চেষ্টায় মানসিক বুঝ পাওয়া সম্ভব হলেও দেশ-জাতির জন্য বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। 

দেড় দশকের স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রচণ্ড ক্ষোভের বিস্ফোরণ ও সকল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটা প্রথা বাতিলের অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রক্ষমতা হারানোর প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সংকট মোচনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। বিরাজনীতিকরণ ধারায় এনজিও, অবসরপ্রাপ্ত সামরিকও প্রশাসনিক আমলা, শিক্ষক পরে ছাত্র প্রতিনিধিরা এই সরকারের পার্টনার। প্রাথমিকভাবে এই সরকারের বিষয়ে বেশি সমালোচনা না হলেও নাগরিক অধিকার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নতুন করে ভ্যাট আরোপ, গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত স্বল্প মূল্যের পণ্যের কার্ড বাতিল, বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই হত্যাকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা, মুক্তিযোদ্ধাদের হেনস্তা করা, কিংস পার্টির আদলে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘটনা সরকারের কাজ ও ক্ষমতার মেয়াদ নিয়ে জনমনে ভাবনার জন্ম হয়েছে, যা প্রচার মাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কম-বেশি প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে। 

দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা নানামাত্রিক বৈষম্য দূরীকরণে বিভিন্ন বিষয়ে ৫টি সংস্কার কমিটি গঠিত হয়েছে, এটি একটি ভালো দিক তবে এদের কাজের প্রেক্ষিতে  এদের অনেকের সামনেই সমালোচনার বিষয়টি দেশবাসী দেখেছে। তবে এদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যটা জাতির সামনে আরেকটু পরিষ্কার হলে জাতির শঙ্কা দূর হতো। কারণ চুন খেয়ে গাল যাদের পুড়েছে তাদের দই দেখলেও ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সমাজের দায়িত্বশীল মানুষ থেকে যা বলা হয়েছে, তা না করার কারণে সমাজদেহে যে নেতিবাচকতার সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনীতিতে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের ব্যবহার করে এগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর আগমন, কিংসপার্টি গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়ার ঘটনা রাজনীতিবিদদের যেমন শঙ্কায় ফেলেছে তেমনি রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা এবং দক্ষিণমুখী প্রবণতা পকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো পশ্চাদপদ রাজনীতির দিকে ধাবিত হবে কিনা সে শঙ্কাও আছে। 

আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ, নারীদের শিক্ষা বন্ধ করা, বৈধ আত্মীয়-পরিজন ছাড়া বাইরে গমন নিষিদ্ধ করা, ইরানে নৈতিক পুলিশের খবরদারি, মেয়ে ও স্বাধীন মতের মানুষদের উপর জুলুম করার ঘটনা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণ অভ্যুত্থানের পর বায়তুল মোকাররম মসজিতে মারামারি, তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু, কাকরাইল মসজিদের দখল নিয়ে মসজিদ ঘেরাও, গাজীপুরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাগের মাথায় তালাক প্রদান পরবর্তিতে সংশোধনের জন্য মসজিদের একজন ইমামের শরণাপন্ন হলে ওই ইমাম সাহেব হিলা বিয়ের ফতোয়া দিয়ে নিজেই বিবাহ করেন এবং মসজিদে সহবাস করে এবং ১ ঘণ্টা পরে তালাক দেয়ার ঘটনা, সেই সাথে অসংখ্য মাজারে হামলা ভাঙচুরের ঘটনা, ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা মানুষকে ভাবাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের জোরালো প্রতিবাদ না আসায় এদের সম্পর্কে জনগণের একটা নেতিবাচকতার সৃষ্টি হয়েছে। 

কাওয়ালি গানের জন্য পাকিস্তান থেকে শিল্পী আনা, কনসার্ট বন্ধ করে সেই স্টেজে নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার কোনো একটা ঘটনা আইনের মুখোমুখি না করা জনমনে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের ক্ষেত্র বিশেষে দাদাগিরি সীমান্তে বাঙালিদের হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের প্রতিবাদ তারা কর্ণপাত করছে না সেইসাথে বর্তমান অবস্থায় ভারতের কিছু মিডিয়া এবং ভারতে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক বিজেপি নেতাদের  লাগামহীন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আহ্বানে জাতীয় ঐক্যের জন্য সকল মতের পথের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বৈঠক হয়েছে। অনেকদিন পর ইস্যুভিত্তিক এ বৈঠকটি হয়েছে তবে দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের বৈঠক হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর ১৫ দল, ৭ দল ও ৫ দল ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে বৈঠক শেষে তিন জোটের রূপরেখা হয়েছিল, সকল দলের মধ্যে সমঝোতা ও ঐকমত্য হয়েছিল, সেটা অনুসরণ করলে হয়তো নতুন স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের জন্ম হতো না। 

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা দুনিয়াজুড়ে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে পায়নি। ৫৩ বছরে অনেক দলই ক্ষমতায় ছিলেন এবং সংবিধানও পরিবর্তন সংশোধন করেছেন কিন্তু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করেননি কোনো সরকার, এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্যও হয়নি এটা একটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। ’৭১ সালের য্দ্ধুাপরাধীরা তাদের কাজের জন্যতো ভুল স্বীকার করেনি বরং ’৭১ সালে অধ্যাপক গোলাম আজম যেমন বলেছিল সেনাবাহিনী ও জামায়াতে ইসলাম দেশপ্রেমিক শক্তি, আজ একই সুরে তাদের নেতারা বলছে সেনাবাহিনী ও তাদের দলই দেশপ্রেমিক।  আওয়ামী লীগ একটি বড় দল, ভাষা স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ ও ’৯০ এর স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখা দল, বর্তমানে নিজেরাই ওই সকল আন্দোলন সংগ্রামের চেতনা ভুলে নিজেরাই ফ্যসিবাদী হয়েছে, তারপরও তাদের বিরাট একটা ভোট ব্যাংক ছিল, যার পরিমাণ ৩০% এর মতো। এই ৩০% লোকের প্রতিনিধিত্বকে বাদ রেখে জাতীয় ঐক্য কীভাবে সম্ভব। এই প্রশ্ন অনেকেই সামনে এনেছেন। দলটির যেসব নেতাকর্মী স্বৈরাচারী আচরণ করেছে, লুটপাট, সম্পদ পাচার এবং জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। 

মহান মুক্তি সংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক চেতনা যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ছাড়বে না তেমনি যুদ্ধাপরাধীরা এটাকে গ্রহণ করবে না। এমনতর বাস্তবতায় জাতীয় ঐক্য হওয়া কঠিন কাজ। জাতীয়তাবাদীরা পুঁজিবাদের অনুসারী, সে দিক থেকে মৌলবাদীদের সাথে ক্ষমতার প্রয়োজনে ঔক্য হলেও সেটাও সাময়িক। বৃহৎ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আদর্শিক জায়গা থেকে পার্থক্য নেই তবে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পার্থক্য আছে। সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে জাতীয়তাবাদীদের সাথে বামপন্থিদের সাময়িক ঐক্য হলেও আদর্শিক দিক থেকে হওয়া সম্ভব নয়, ডান-বাম মৌলবাদীদের নিয়ে ঐক্য হওয়া আর তেল-জলে এক হওয়ার মতো ব্যাপার। 

ধর্মের নামে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী পাকিস্তান, আফগানিস্তান সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান এর অর্থনৈতিক অবস্থা সামাজিক স্থিতিশীলতা মানবাধিকার শিক্ষা  বিজ্ঞান ও নতুন সৃষ্টি থেকে যোজন-যোজন দূরে অবস্থান করছে। মসজিদে বোমা হামলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বোমা মেরে মানুষ হত্যা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব ঘটনা দেখার পরও কি মানুষ জেনে-শুনে জ্বলন্ত চুলা থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে ঝাঁপ দিবে? ১৯৭১, ৯০ আর ২৪ এর শহীদদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমন অনেক বিষয়েই এই মুহূর্তে ঐক্যে দরকার।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক