বাংলাদেশের পরিচয় একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ। ‘বঙ্গ’ নামটি যেখানে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য থেকে উঠে এসেছে, সেখান থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সবকিছু মিলে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে। ‘বঙ্গ’ শব্দটি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রে পাওয়া যায়। মূলত এ শব্দটি প্রাচীন-কালে জাতিবাচক ছিল, দেশবাচক নয়। ঐতিহাসিকদের মতে, বঙ্গ শব্দটি সম্ভবত দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে।
ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে বঙ্গ এলাকার কোনো সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা ছিল না। অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সীমারেখার পরিবর্তন ঘটেছে এবং বঙ্গ গোত্রের এবং জাতির মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করেছে। তবে ক্রমান্বয়ে ভাষার নির্দিষ্টকরণ যখন সম্ভবপর হল তখন থেকে ভাষার সাহায্যে বঙ্গ অঞ্চলকে চিহ্নিতকরণ সহজতর হলো। অর্থাৎ যে অঞ্চলের লোকেরা বাংলা ভাষায় কথা বলে তারাই বাঙালি এবং যে এলাকায় বসবাস করে সেটাই বঙ্গ। পাল রাজত্বকালে বিহারে যে সমস্ত ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা গড়ে উঠেছিল সেগুলো বঙ্গভূমিরই সংস্কৃতির প্রসার ছিল।
সে সময়কালে এ সংস্কৃতি নেপাল, তিব্বত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রসারিত হয়েছিল। সমুদ্রতীরবর্তী বলে এবং গঙ্গাবিধৌত বলে বঙ্গভূমি চিরকাল উর্বর ছিল। কৃষি ছিল এখানকার মানুষের পরিচিত জীবিকা। উৎপাদিত শস্যের প্রাচুর্য প্রাচীনকালেও এ অঞ্চলকে পৃথিবীর কাছে প্রধান করেছিল। হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর উৎপত্তি এই বঙ্গভূমিতেই। ভূমধ্যসাগর থেকে গঙ্গা নদী ছিল বহুদূরে অবস্থিত। বঙ্গভূমির সংস্কৃতি গঙ্গা নদী বহুদূরে অবস্থিত। বঙ্গভূমির সংস্কৃতি বঙ্গের বাইরে ছড়িয়ে ছিল এটা যেমন সত্য তেমনি আবার বাইরে সংস্কৃতিও বঙ্গভূমির অধিকাংশ অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। সম্রাট সমুদ্রের সময় উত্তর ও পশ্চিমবংঙ্গ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়।
ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ এ অঞ্চলে ঘটে সমুদ্রগুপ্তের পরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বিশৃঙ্খলা অবস্থা দেখা দেয় এসব অঞ্চলে। কিন্তু শশাঙ্কের উদ্ভবের ফলে কিছুকালের মধ্যে এ অঞ্চলে শৃঙ্খলা আবার ফিরে আসে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বঙ্গভূমিতে প্রায় একশত বছর পর্যন্ত অরাজকতা চলে। ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পুত্র দেবপালের রাজত্বকালে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের একজন বৌদ্ধ নৃপতি বালপুত্রদেব বালিন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ স্থাপনে সহায়তা করেছিলেন। সমগ্র ভারতের ইতিহাসে বাঙালি জাতির এই আশ্চর্য উত্থান তুলনাহীন। ধর্মপাল এবং দেবপালের সময় সমগ্র ভারতের বঙ্গভূমির প্রভাব ছিল অপরিসীম। এদের রাজত্বকালে আরব ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সূত্রে বাংলাদেশে এসেছেন এবং বাংলাদেশের গৌরব কীর্তন করেছেন।
নারায়নপালের সময়কালে পাল সাম্রাজ্যের প্রভাব বলয় সংকুচিত হতে হতে শুধুমাত্র বঙ্গভূমিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পাল রাজত্বকালে বহির্ভারতের ইসলাম বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তুখারিস্তানে আরবদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই সংবাদ বঙ্গভূমিতে ও এসেছিল এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও চর্চায় ইসলামের প্রভাব পড়া বিচিত্র নয়। ৭০৯ খ্রিস্টাব্দে বোখারা মুসলমানদের করতলগত হয়। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক পুত্র ওয়ালিদের সেনাপতি সিন্ধু বিজয় করেন এবং এখন থেকে চিরকালের জন্য সিন্ধুদেশ মুসলমানদের অধিকারে থাকে। ৭১৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব তুকিস্তানে ইসলাম উপনীত হয়, এর ফলে মধ্য এশিয়ায় হাজার হাজার বৌদ্ধ সংঘারাম বিলুপ্ত হয়।যখন মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হচ্ছে তখন বঙ্গভূমিতে পাল সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তি সংহত হচ্ছে। এ সময়কালে সমগ্র পৃথিবীতে বৌদ্ধ চিন্তার এবং গবেষণার কেন্দ্রভূমি হয় বঙ্গভূমি। বৌদ্ধ নীতিবোধের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের প্রভাব এ অঞ্চলে এসেছিল। ইসলামের প্রভাব এসেছিল দু’ভাবে- আরব বণিকদের প্রত্যক্ষভাবে এবং গৌণভাবে।
বঙ্গভূমির অস্তিত্ব স্বীকৃতি থাকলেও মূলতঃবৌদ্ধ পাল সম্রাটগনের সময় একটি সুসংহত ভৌগোলিক সীমারেখায় বঙ্গভূমি সুচিহ্নিত হয়। বঙ্গ ভূ-ভাগে যখন বিশৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল এবং মাৎস্যন্যায় প্রচলিত ছিল তখন পাল সাম্রাজ্য সে অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সর্বদেশে স্বস্তি ও সম্ভ্রম ফিরিয়ে আনে। পালরা ছিলেন বঙ্গদেশবাসী বৌদ্ধ। কিন্তু সেনরা ছিলেন কনার্টকবাসী বহিরাগত। বিজয় লালসায় অগ্রসর হয়ে তারা বঙ্গভূমিতে তাদের অধিকার বিস্তার করেছিলো। এ সময়কালে আদিশূর কান্যকুজ থেকে ব্রাহ্মণ আনিয়েছিলেন এবং আর্যাবর্তের বর্ণাশ্রম ধর্ম সেই সঙ্গে বঙ্গ ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল? আদিশূররের সময়কার ব্রাহ্মণরা এদেশের জাতিভেদ প্রতিষ্ঠিত করল এবং তখন থেকে নি¤œবর্গের মানুষ অবহেলিত হতে থাকল। কিন্তু জাতিভেদের প্রভাব বঙ্গভূমিতে প্রাধান্য পায়নি। যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত সে অঞ্চলের মানুষ একটি মিশ্র জাতিসত্তা এবং বিভিন্ন জাতি উপজাতি এখানে এসে মিলিত হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments