Image description

দীর্ঘদিন পর এবারই প্রথম বই উৎসব ছাড়া শুরু হয় নতুন শিক্ষাবর্ষ। দুঃখজনক হলেও সত্য- শিক্ষাবর্ষের দুই মাস পার হলেও বাকি বই পৌঁছায়নি শিক্ষার্থীদের হাতে। বছরের প্রথম দিনে বই উৎসবের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠ্যপুস্তক পেয়ে থাকে। এদিনটি শিক্ষার্থীদের আনন্দের দিন। তারা খুশিমনে স্কুলে যায় এক উৎসবমুখর পরিবেশে বই আনার জন্য। নতুন বই পেয়ে তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ছাপানোর কাজ শেষ না হওয়ায় এ বছর বই উৎসবই হয়নি। 

ফলে শিক্ষার্থীদের আনন্দ অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। এবার নতুন শিক্ষাবর্ষে আনন্দের পরিবর্তে পড়ালেখা চলছে টেনেটুনে। অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ প্রতিশ্রুতি ছিল ফেব্রুয়ারিতে সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সর্বশেষ প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করতে পারবে কিনা- তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে এখনও ১২ কোটি বই ছাপাই হয়নি। যেসব বই ছাপা হয়েছে সেগুলোও বাইন্ডিংয়ে যাচ্ছে না। মুদ্রণ মালিকদের কাছ থেকে কাগজ বাবদ অগ্রিম যে টাকা নেয়া হয়েছে তার বিপরীতে তাদের কাগজ দেয়া হচ্ছে না। 

ফলে ফেব্রুয়ারিতে সব বই পাবে না শিক্ষার্থীরা। জানা যায়- রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নবম ও দশম শ্রেণির মাত্র তিনটি বই দিতে পারলেও বাকি বইগুলো দিতে পারেনি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণির একটি বই দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জানানো হয়, মাধ্যমিকের কোনো শ্রেণির তিনটি, কোনো শ্রেণির দুই-একটি, আবার কোনো শ্রেণির কিছু বই পাওয়া গেছে। 

তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি বই পেয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের এই চিত্র কেবল ঢাকার এই পরিচিত বিদ্যালয়ের নয়, গ্রাম থেকে শহর-কমবেশি সবখানেই এমন চিত্র। ফলে রুটিন মেনে হচ্ছে না ক্লাস। বাড়িতেও পড়ালেখা করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। সবমিলিয়ে শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাস শেষে ঢিমেতালে চলছে পড়াশোনা। বই না পাওয়ায় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আনা যাচ্ছে না। যারা আসছে, তারা অমনোযোগী থাকছে। বাড়িতেও তাদের পড়ার কিছু নেই। এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরনের শিখন ঘাটতি নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে উঠবে শিক্ষার্থীরা, যা তাদের শিক্ষাজীবনে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করবে। 

শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই দেয়া নিয়ে সরকারের এমন খামখেয়ালিপনায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে জীবন দিয়ে তাদের সরকারে বসিয়েছে। তাদের কল্যাণে সরকারের নজর দেয়া উচিত।

এনসিটিবির তথ্যমতে, এখনও ১২ কোটির মতো বই ছাপানো বাকি। আরও তিন কোটি বই ছাপা হলেও বঁাঁধাই হচ্ছে না। ফলে ১৫ কোটি বই শিক্ষার্থীদের পেতে আরও বিলম্ব হবে। তিন কোটি পাঠ্যবই ছাপার পর তা বাইন্ডিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু লোকসানের ভয়ে বই ছাপার পরও বাইন্ডিংয়ে দেয়া হয়নি। জানা গেছে, এক হাজার ফর্মা ইন্টারলিপ করতে বাইন্ডাররা ১৮০ টাকা নিয়ে থাকে। প্রিন্টাররা তাদের ১৩০ টাকা দিতে চেয়েছিল। এনসিটিবির পক্ষ থেকে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তাতেও ৩০ টাকা করে লোকসান হবে, সে কারণে বেশ কিছু মুদ্রণ মালিক ছাপার পরও বই বাউন্ডিংয়ে পাঠাচ্ছে না।

এমন চিত্র বলে দেয়- শিক্ষার্থীদের সব বই হাতে পেতে এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য- অধিকাংশ স্কুলেই শিক্ষার্থীরা শুধু যাওয়া-আসা ও খেলাধুলার মধ্যেই রয়েছে। বই ছাপার যে পরিস্থিতি, তাতে সেই পরিকল্পনাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে কি না, সেটাও অনিশ্চিত। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা আরো দেরিতে বই হাতে পেলে তারা পিছিয়ে যাবে। মহৎ এ উদ্যোগ সময়মতো না করার কারণে যদি ম্লান হয়ে যায়- তা হবে অত্যন্ত পরিতাপের। আমাদের কথা হলো- চেষ্টাটা যেন আন্তরিক হয়। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষকে সব বিষয়ে অবশ্যই গভীর মনোযোগ দিতে হবে। নতুন বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব করতে না পারা এবং এখনও বই না পৌঁছানো অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা, যার দায় সরকারকেই নিতে হবে। 

আরেকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি- যেহেতু বছরের প্রথম দিন সব বই দেয়া সম্ভব হয়নি, পরের প্রতিশ্রুতি যেন ভঙ্গ না হয়। আমাদের প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রম সম্পন্ন করে যত দ্রুত পারা যায় শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। এবার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে একদিকে শিক্ষার্থীদের মন ভেঙে পড়বে, অন্যদিকে সরকারের ওপর আস্থা হারাবে জনগণ। তাই দ্রুত প্রতিশ্রুতি রক্ষায় উদ্যোগ নিন।