Image description

দেশে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ধারাবাহিকভাবে যৌন সন্ত্রাসের ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক নেমে এসেছে কর্মজীবী নারী, শিশু, ছাত্রী, শিক্ষিকা ও গৃহবধূদের মধ্যে। ঘরে-বাইরে কোথাও কন্যাশিশু ও নারীরা নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক কালে এমন কিছু নারী ও শিশু নিগ্রহ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যা পুরো সমাজকে ভীষণ ধাক্কা দিয়েছে। 

শুধু যে রাতের অন্ধকারে, নির্জন রাস্তায়ই নারীর সম্ভ্রম লুট করা হচ্ছে, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্তচিন্তার নিরাপদ পরিবেশেও উচ্চ শিক্ষার্থী নারীও নিরাপদ বোধ করতে পারছেন না। এসব জায়গাও সুযোগ-সন্ধানী ধর্ষকের দল ওতপেতে আছে। আকস্মিক এ ধরনের যৌন সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্যে সর্বত্র উদ্বেগ নেমে এলেও পুলিশ হাঁটছে সেই পুরনো পথেই। কোনোভাবেই ধর্ষণ রোধ হচ্ছে না, বরং বাড়ছেই। 

গত সপ্তাহে মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আট বছরের শিশুটি যেভাবে ধর্ষণের শিকার হলো, তা সমাজের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে বললেও কম বলা হবে। একটি শিশু বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে আর এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বোনেরই শ্বশুর নামের এক পাষণ্ড। দুঃখজনক হলেও সত্য- পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নিগ্রহের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে পরিবারের সদস্য ও স্বজনের মাধ্যমে। 

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার হয়ে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন শিশুটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তার স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলেও বেঁচে উঠবেন কিনা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। শুধু আছিয়া নয়- সম্প্রতি এমন ঘটনার শিকার হয়েছে এমন নারী-শিশুর সংখ্যা একেবারে কম নয়। নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে উত্তাল সারাদেশ। 

গোটা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। নারী নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে ও ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে রবিবার বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারীবাদী সংগঠনগুলো। এই কর্মসূচি থেকে ধর্ষণসহ অব্যাহত নারী নিপীড়ন প্রতিরোধে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর অপসারণ এবং দ্রুত ট্রাইব্যুনালে সব ধর্ষণ-কাণ্ডের বিচারসহ ৯ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সবারই এক দাবি, এক বক্তব্য। 

এসব সমাবেশে বক্তারা বলেন- মানুষ মূলত নির্যাতন করে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য। মানুষ জানে নারী নিপীড়ন করলে শান্তি হয় না, বরং সমাজ সেটাকে নরমালাইজ করে। এজন্য দেশে নারী নিপীড়ন সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ধর্ষিতারা পরতে পরতে উপেক্ষিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্ষকরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোনো শাস্তি হয় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ রকম ক্ষেত্রে অভিযুক্ত হিসেবে একজন নারীর মামলা চালানো কঠিন ব্যাপার। 

আমাদের সমাজে নারীদের পরতে পরতে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। যেমন ধর্ষণের একজন ভিকটিমকেও নিজের প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষিত হয়েছে এবং বিচার চলাকালে তাকে দোষারোপ করার প্রবণতাও দেখা যায়। ছোট শহরগুলোতে অনেকেই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার কারণে অনেক সময় চাইলেও সাহস করে এগিয়ে আসেন না অনেক আইনজীবী। 

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশুরা। এক বছর বয়সী শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা এ বর্বরতার শিকার হচ্ছে। দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। পাঁচ বছরে ছয় হাজারের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণ। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ছয় হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। এ সময় ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২৪১টি। দুঃখজনক হলো, নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর প্রায়শই গণমাধ্যমে আসে। আমরাও মনে করি, এ ধরনের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পান, কর্তৃপক্ষকে তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন জরুরি। 

দেশে ধর্ষণের ঘটনা যাতে না ঘটে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার জন্যও নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দিতে হলে প্রথমত আমাদের বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের যথাযথ হস্তক্ষেপ জরুরি।