Image description

জন্মনিবন্ধন  মানুষের যাপিত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। জন্ম সনদ নিয়ে জটিলতায় লাখো মানুষ- অথচ প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জন্ম নিবন্ধন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বেশ কিছু সুবিধা আদায় জন্ম সনদ ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। কিন্তু এই নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে গিয়ে বাবা-মা জানতে পারছেন, তাদের নিবন্ধন করাতে হবে নিজের স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে। 

সন্তানের বাবা ও মা দুটি ভিন্ন জেলার বাসিন্দা হলে সেই বিড়ম্বনা আরও বেশি। এমন বিড়ম্বনার অন্ত নেই। গতকাল প্রকাশিত সংবাদসূত্রে জানা যায়- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তরখানের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলের জন্ম সনদ সংগ্রহের জন্য অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বীথি আক্তার। কিন্তু দ্বিতীয়বারের মতো তাকে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে কর্মকর্তা না থাকায় আরেকদিন আসতে বলল। কিন্তু কেউ আমাকে বলতে পারেনি, আমি কবে আসব।’

এমন অভিযোগের শেষ নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার করণে নতুন জন্ম নিবন্ধন অথবা সংশোধন সব বিষয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। অন্যদিকে একই ব্যক্তির নামে একাধিক জন্ম নিবন্ধন করার সুযোগ থাকায় এটি নিয়ে অনিয়ম বেড়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অফিসের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম নিবন্ধন নেই। এটি একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, কারণ সরকার ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সব নাগরিকের জন্য ১৮ ধরনের পাবলিক সেবা পাওয়ার শর্ত হিসেবে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। এরমধ্যে রয়েছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন এবং পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন। নিয়ম অনুযায়ী, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে কোনো ফি নেয়া হয় না এবং ৪৫ দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সনদ নেয়ার জন্য ফি ২৫ টাকা। 

তবে, যারা নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন এবং দালালদের সাহায্য নেন না, তারা প্রায়ই সময়মতো তাদের সনদ পান না। গ্রামীণ এলাকাতেও একই রকম সমস্যা দেখা গেছে। প্রশাসনিক অদক্ষতা, প্রযুক্তিগত সমস্যা এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে বহু নাগরিক জন্ম সনদ পেতে ব্যাপক ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। অসাধু কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে এ ধরনের যথেচ্ছাচার সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। তথ্যানুযায়ী, জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত এমন সমস্যা এখন প্রতিটি পর্যায়ে। নানা জটিলতার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুরেও সমাধান মিলছে না অনেকের। এর সঙ্গে কর্তাদের গাফিলতি নিয়মিত ঘটনা। 

জন্ম নিবন্ধনের মতো প্রয়োজনীয় একটি বিষয়ে এত জটিলতা রাখা বাস্তবসম্মত নয়। সাধারণ মানুষের জন্য সহজ পদ্ধতি হলে এ ধরনের ভোগান্তি হতো না বলে মনে করছেন তারা। যেখানে জন্ম নিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় সন্তানের জন্ম সনদ নিতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। একই সঙ্গে কারও মৃত্যুসনদ নিতে হলেও প্রয়োজন হচ্ছে ডিজিটাল জন্ম সনদের। সব মিলিয়ে চরম জটিলতায় পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। বাস্তবায়নে বিবিধ জটিলতার কারণে এখন ভোগান্তির নামই হয়ে পড়েছে জন্ম নিবন্ধন। এই অবস্থার অবসান জরুরি। 

প্রশ্ন হচ্ছে- দুই দশক পেরিয়ে কেন স্বচ্ছ জন্ম নিবন্ধন সম্ভব হলো না? তবে দায়িত্বশীলদের মতে, সনদ দেয়ার জন্য অফিস ও জনবল সংকটে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। নতুন করে কিছু অঞ্চল যুক্ত হওয়ায় এক অঞ্চলের অফিসেই তিন অঞ্চলের সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেয়া হচ্ছে, যা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই সত্বর প্রয়োজনীয় লোকবল নিশ্চিত করা আবশ্যক। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নাগরিকদের তাদের আবেদন পরিস্থিতি অনলাইনে ট্র্যাক করতে, ডিজিটালি পরিবর্তন করতে এবং সময়মতো আপডেট পেতে সহায়তা করে। জন্ম সনদের জন্য আবেদনকারীদের সরকারি অফিসে বার বার যেতে হয়। 

সরকারের এনআইডি সেবার মতো একটি সিস্টেম চালু করে প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আবেদন প্রক্রিয়ায় মানুষের উপস্থিতিতে শুধু অতিরিক্ত জটিলতা এবং দেরি হয়। তাই ডিজিটালাইজেশনই সমাধান। যদি মানুষ অনলাইনে আবেদন করতে পারে, ডকুমেন্ট আপলোড করতে পারে এবং সনদ প্রস্তুত হলে একটি নোটিফিকেশন পায় তাহলে অনেক ঝামেলা কমে যাবে। সর্বোপরি নিবন্ধনের প্রক্রিয়া যথাসম্ভব সহজ করা দরকার। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।