Image description

রাজা অশোক ভারতীয় উপমহাদেশের মগদের তৃতীয় মৌর্য সম্রাট (২৬৮-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তার সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বড় অংশজুড়ে, আফগানিস্তান থেকে বর্তমান বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার রাজ্য সীমা। যতদূর জানা যায় রাজা অশোকের সময়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দিকে তিন দিন একটি কুঠুরিতে বেঁধে রাখা হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে জেলখানার উদ্ভব এভাবে হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে। অশোকের পরেও কয়েদ খানার অস্তিত্ব ছিল। তবে উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আগমনের পর মূলত কারা ব্যবস্থাপনা নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পায়। 

১৮১৮ সালে রাজবন্দিদের আটকার্থে বেঙ্গল বিধি জারি করা হয়। বর্তমানের বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ (১৭৯৩), যশোর, কুমিল্লা এবং কয়েকটি জেলা ও মহকুমা কারাগার উক্ত সময়ে নির্মিত হয়। তবে ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কারাগারের কাজ শুরু হয়। ১৮৬৪ সালে সকল কারাগার পরিচালনা ব্যবস্থাপনার মধ্যে এক সমন্বিত কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত হয় কোড অব রুলস চালুর মাধ্যমে। ১৯২৯ সালে অবিভক্ত বাংলায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি, আলীপুর, মেদিনীপুর, ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষিত হয়। কারাগার আধুনিক সভ্যতায় বন্দিদের সংশোধন ও সু-প্রশিক্ষিত করে সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান। 

বিভিন্ন কারণে মানুষ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে। আইন অনুসারে শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি তাকে সংশোধন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব কারা বিভাগের। বাংলাদেশ জেল প্রথম যাত্রা শুরু করে ১৭৮৮ সালে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৩টি জেলা কারাগার এবং ৪৩টি উপ-কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল (বিডিজে) যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে বন্দি সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উপ-কারাগারগুলোকে জেলা কারাগারে রূপান্তর করা হয়।

দিন ক্রমশ বদলেছে। ডিজিটাল জগত বদলে দিচ্ছে অনেক কিছু। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। চারদিকে কত উন্নয়ন। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র কত কি! ২০ বছর আগের বাংলাদেশকে এখনও কেউ ভাবতেই পারবে না। শুধু অপরিবর্তিত থেকে গেছে জেলখানাগুলো। মানুষের অপরাধ শোধন করতে জেলখানা যেখানে আধুনিক হওয়া দরকার সেখানে জেলখানায় যুক্ত হয়েছে ‘লোহার খাঁচা’। মানে লোহার খাঁচা আগে ছিল তা নয়। 

আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৫ সালে ঢাকায় নতুন সিএমএম আদালত ভবন উদ্বোধনের পর এজলাস কক্ষে প্রথম লোহার খাঁচা দেখা যায়। রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, অধস্তন আদালতে অতীতে লোহার খাঁচা ছিল না। বর্তমানে ৮৪টি আদালতে এ ধরনের খাঁচা রয়েছে, এর ৭৪টিই ঢাকায়। চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতে এরকম খাঁচা রয়েছে বলে জানা গেছে। যদি আসামির আচার-আচরণ দুর্ধর্ষ ও বিপজ্জনক বলে তাদের অতীত রেকর্ড আছে, ডিজিটাল যুগে তাদেরকে কারাগারে রেখেই ভিডিয়োর মাধ্যমে বিচারকাজে যুক্ত করা হয়। তা নিয়েও বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। 

বিচার ব্যবস্থার উন্নতির জন্য শুধু লোহার খাঁচা নয়, সবদিক থেকেই আমাদের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে লোহার খাঁচায় পুরে রাখা অমানবিক, মানহানিকর। 

জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান ১৯৯৮ সালে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি গঠন করেন। ২০০১ সালে তারা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার একটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে। পরের বছর ২০০২ খ্রিস্টাব্দে পহেলা মে নাটোরের একটি সিনেমা হলে, ডিসেম্বরে ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা করা হয়। তবে যে প্রেক্ষিতেই কাঠগড়ার পরিবর্তে লোহার খাঁচা করা হলো। তার মানে দাঁড়ালো এই যে ভয়ানক কোনো আসামির সঙ্গে একজন অভিযুক্ত শিক্ষকও সমান অবস্থানে থাকবেন। এ ধরনের যুক্তি কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তারপরও লোহার খাঁচার বিরুদ্ধে সমালোচনা ও অপসারণের দাবি বিভিন্ন সময় উঠেছে। তারপরও আদালতের বেশকিছু এজলাস কক্ষে আসামিদের জন্য লোহার খাঁচা রয়েই গেছে। এসব এজলাসে মামলার শুনানিকালে আসামিদের ওই খাঁচায় রাখা হয়। 

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুনানিকালে লোহার খাঁচায় থাকার ঘটনায় বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে এ সময়। আইনজীবীরা বলছেন, লোহার খাঁচা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব খাঁচা অপসারণ চেয়ে করা রিটের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুলও দিয়েছেন। কতগুলো আদালতে লোহার খাঁচা রয়েছে, সে বিষয়ে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতেও নির্দেশ দেন। তবে প্রতিবেদন দেয়া হয়নি আজও। কবে দেয়া হবে তা-ও জানে না কেউ। 

আইনজীবীরা বলছেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৮৪টি এজলাস কক্ষে লোহার খাঁচা রয়েছে। পরিবেশ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সভ্য সমাজে আদালতে লোহার খাঁচা থাকা উচিত নয়। কেননা, সংবিধান অনুযায়ী কোনো নাগরিকের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করা যাবে না। তবে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বা জঙ্গির ক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। 

গত ১২ জুন গ্রামীণ টেলিকমের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার একটি আদালত। সেদিন অন্য ১৩ আসামির সঙ্গে ড. ইউনূসও এজলাস কক্ষে আসামিদের জন্য স্থাপিত লোহার খাঁচায় ছিলেন। 

অভিযোগ গঠন শেষে তিনি বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাই জানে, যতক্ষণ একজনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ তিনি নিরপরাধ। নিরপরাধ ব্যক্তিকে কেন লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হবে? এটার অবসান হওয়া উচিত। একজন নিরপরাধ নাগরিককে লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘যদিও আমাকে বলা হয়েছিল এজলাসে থাকতে। কিন্তু আমি নিজেই অন্যদের সঙ্গে খাঁচায় ঢুকেছি।’ 

এরপর এজলাস কক্ষে লোহার খাঁচার বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। এটি প্রথম আলোচনায় আসে গত বছরের ১৬ অক্টোবর লোহার খাঁচা অপসারণ চেয়ে ১০ আইনজীবীর দেয়া আইনি নোটিশের কারণে। আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর নোটিশটি পাঠানো হয়েছিল। জবাব না পেয়ে গত ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন ওই আইনজীবীরা। রিটের প্রেক্ষিতে ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করেন। 

রুলে লোহার খাঁচা স্থাপন সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে কেন সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে লোহার খাঁচা অপসারণ করে পুনরায় কাঠগড়া স্থাপন করতে পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এ রকম খাঁচা থাকা আদালতের তালিকা ৬০ দিনের মধ্যে দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে সম্পূরক আবেদনের প্রেক্ষিতে ৬ জুন এ বিষয়ে আরেকটি রুল দেন হাইকোর্ট। 

উক্ত রুলে ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস-এর ৮২ বিধি কেন সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। তার কোনো সুরাহা আজও হয়নি।

কিন্তু এ ধরনের খাঁচা স্থাপন সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এগুলো অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। 

নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে লোহার খাঁচা করা হয়েছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুল্লাহ বলেন, আসামিরা অনেক সময় কাঠগড়াতে খারাপ আচরণ করেন। বিচারকের দিকে অনেক কিছু ছুড়ে মারেন। বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাঠের কাঠগড়া বাদ দিয়ে লোহার কাঠগড়া বানানো হয়েছে। আগে কাঠগড়া উন্মুক্ত ছিল আর এখন পুরোটাই বেষ্টনী দেয়া হয়েছে। 

এজলাস কক্ষে কাঠগড়ার বদলে লোহার খাঁচা বা পিঞ্জিরায় আসামি রাখা সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে মনে করেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা আছে, আসামিকে শুধু নির্যাতন করা যাবে না তাই না, তার সঙ্গে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করা যাবে না। 

তিনি বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র যত সংকুচিত সেই দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বর্বরতা এবং কঠোরতা বাড়ে। 

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আমাদের আদালতগুলোতে ব্রিটিশ আমল থেকেই ‘সাক্ষীর কাঠগড়া’ রয়েছে। ব্রিটিশরা চলে গেছে সেই কবে। তারপর পাকিস্তানি শাসন এরপরে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ হয়েছে। ব্রিটিশরা চলে গেলেও ব্রিটিশদের আইন-কানুন সব রয়ে গেছে। শুধু ব্রিটিশদের আাাইন-কানুনই না জেলের ভেতর থেকে বাহির বলতে গেলে অনেক বিষয় আছে বলা যায় না। এখনও মানসিকতায় যদি চিন্তাপর উপনিবেশ থেকে যায় তাহলে ব্রিটিশ গেলেও ব্রিটিশরা টিকে থাকবে আমাদের মননে মস্তিস্কে। আমরা আধুনিক মেট্রোরেল জগতে থেকে অপরাধ না করলেও সেটা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত লোহার খাঁচায় থাকব এটা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য না। এ সিস্টেম অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লোহার খাঁচা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও খুবই দৃষ্টিকটু। হয়রানি করার জন্যও অনেক মামলা হয়। একটা পর্যায়ে গিয়ে আসামি খালাস পাওয়ার ঘটনাও অনেক। এমন পরিস্থিতিতে মামলা হলেই নাগরিককে খাঁচার মধ্যে রাখা অবমাননাকর। 

তিনি বলেন, কোনো আসামি পালানোর আশঙ্কা থাকলে বা গুরুতর অপরাধে জড়িত আসামি হলে তার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রবিধানে কিছু বিধান উল্লেখ করা আছে। কিন্তু সব আসামিকে খাঁচার ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেককে নিরপরাধ ধরে নিতে হবে। 

সুতরাং একজন বড় অপরাধী আর একজন সাধারণ মানুষের জায়গা একটা খাঁচায় হবে এটা কোনোমতেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আমরা ব্রিটিশ রাজকে তাড়িয়েছি। পাকিস্তানিদের শাসনের জিঞ্জির ভেঙেছি। আর আমরা যেন খাঁচামুখী না হই। এই খাঁচা আদালত থেকে অপসারণ একান্ত জরুরি।


মানবকণ্ঠ/এফআই