Image description

মানুষ জীবিকা অর্জনের জন্য যে কাজ করে সেই কাজকে তার পেশা বলে। পেশা হচ্ছে কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ পরবর্তী জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরি বা অন্য কোনো বৃত্তিবিশেষ। এর মাধ্যমে তিনি অর্থ উপার্জন করেন বা জীবিকা নির্বাহ করেন। 

সময়ের চরিত্রেই সবই, সবই চলে তার নিয়মে। বহমানতাকে আঁকড়েই আমাদের জীবন-যাপন। জীবন বা সময় দুটোই একে অপরকে পরিপূরণ করতে করতেই এগোয়, এগোতে থাকি ক্রমশ আমরাও। কাল থেকে উত্তীর্ণ হওয়া মহাকালে। আমাদের কাছে কোনোটিই খুব প্রত্যাশিত নয়, বরং হঠাৎ বাঁকে পড়ে অন্যদিকে ঘুরে যায় সেই গতিমুখ, আবার সেই বদলের সাথে মানিয়ে চলতে চলতে এগোনো, এভাবেই নিরন্তর প্রবাহ। কালের যাত্রায় পাল্টায় অনেক কিছু। পরিচিত পথ অপরিচিত হয়ে যায়, কালের যাত্রার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয় পেশাও। 

পেশা বদলায় সময়ের টানে, নতুন পেশা আসে জীবিকায় গতি নামে কিংবা অন্ধকার। তার মধ্যেও বদলায় সবই, সব বদলে নতুনকে আবাহন করাই যেন মানুষের প্রচলিত কাজ, কাজের ধরন। কালের নিয়মেই সময়ে-অসময়ে পাল্টায় সময়ের নিয়ম, গতি-প্রকৃতি। এটা মেনে নেয়াই প্রগতিশীলতা। কোনকিছু আঁকড়ে ধরে থাকারই এক ধরনের রক্ষণশীলতা। তাও সমাজে আছে। তার মধ্য দিয়েই জীবন-জীবিকা রূপান্তরিত হয়।

বাতিওয়ালা: উনিশ শতকের শেষের কথা। সন্ধ্যা হলেই ঢাকা ডুবে যেত নিকষ কালো অন্ধকারে। পরে ১৮৭০ সালে নবাব আব্দুল গণি নিজেই ঢাকায় একটি গ্যাস লাইট ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়াইজঘাটে তত্কালীন মিউনিসিপ্যালিটি অফিস থেকে শুরু করে চকবাজার পর্যন্ত কেরোসিনের ১০০টি সড়কবাতি স্থাপন করা হবে। পরে এ প্রকল্পের আওতায় ৬০টি কেরোসিন ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়। এই কেরোসিন বাতি জ্বালানো-নেভানোর জন্য উনিশ শতকে বাতিওয়ালা নামে এক নতুন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটে। সন্ধ্যা নামলেই বড় বড় মই হাতে এই বাতিওয়ালাদের দেখা মিলত। 

বিদ্যুৎ আসলেও ঢাকা শহরে কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেরোসিন বাতির প্রচলন ছিল। ষাটের দশকেও ঢাকার কয়েকটি গলিতে কেরোসিন বাতির নিয়মিত ব্যবহার দেখা যেত। ১৯৩৫ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার রাস্তায় ৮৬৯টি কেরোসিন বাতি ও ১,০৬৬টি বৈদ্যুতিক সড়কবাতি ছিল।

মিনেট ক্যামেরাম্যান: সর্বশেষ দুটো ক্যামেরা ছিল। বিশাল আকৃতির এই ক্যামেরা কালো কাপড়ে ঢেকে ছবি তুলে এক মিনিটের ভেতরে ডেলিভারি দেয়ার ব্যবস্থা ছিল এই ক্যামেরায়। এই ক্যামেরায় কোনো ফিল্ম বা রিল ব্যবহার করা হতো না। আলোর তাপমাত্রায় এ্যাপারেচার মেপে ছবি তোলা হতো। ক্যামেরা সেট করা কাগজে ছবির ছাপ পড়তো। তারপর তা হাইপোর জলে ধুলেই ছবি হয়ে যেত। এক মিনিটে ছবি হতো বলেই এর নাম ছিল মিনেট ক্যামেরা। আসলে অফিস আদালতে জরুরি ছবির জন্য এছাড়া বিকল্প ছিল না। 

এত চেনা জানা শহর ছিল না তখনো। তাই অফিস-আদালতের কাজ ছাড়াও অনেকের কাছে ছবি তোলা ব্যাপারটাও বিস্ময়ের ছিল। গ্রাম থেকে শহরে আসা এসব সহজ-সরল মানুষের উপভোগ্য ছিল মিনিট ক্যামেরা। মিনিট ক্যামেরাম্যানরা ঢাকারই নাগরিক ছিলেন। ধীরে ধীরে স্টুডিও শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে আসে রিল ক্যামেরা। তাও একদিন অচল হয়ে যায়। আসে ডিজিটাল ক্যামেরা। তারপর এ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের যুগ। এখন মিনিট ক্যামেরা এক উজ্জ্বল ইতিহাস। সেই মানুষগুলো নিশ্চয়ই অন্য পেশার সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে।

গন্ধবণিক: বণিক  হিন্দুদের একটি পেশাজীবী সম্প্রদায়, ব্যবসা-বাণিজ্য যাদের প্রধান বৃত্তি। চতুবর্ণের মধ্যে বৈশ্যবর্ণের উল্লেখ থাকলেও প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণ বা উপবর্ণ হিসেবে বণিক সমপ্রদায়ের তেমন উল্লেখ নেই। মনুসংহিতায় বৈশ্যদের পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালনের কথা বলা হয়েছে; সম্ভবত পরবর্তীকালে এদের থেকেই উপবর্ণ হিসেবে বণিক সমপ্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। 

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে একদল মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিল। তারা বিশ্বের নানা স্থানে বাণিজ্য করত; মশলাদি দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি করত। বারো-তেরো শতকে রচিত বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সুবর্ণবণিক (সোনা ব্যবসায়ী), মোদক (ময়রা), তাম্বুলী (পান ব্যবসায়ী), তৌলিক ও গন্ধবণিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব শ্রেণির মানুষ ব্যবসায়ী ছিল বটে, কিন্তু সকলে বণিকের মর্যাদা পায়নি। 

বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দু সমাজে গন্ধবণিক, সুবর্ণবণিক, সাহা, কুন্ডু, কর্মকার, মোদক প্রভৃতি অনেক শ্রেণির ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের মধ্যে সাহা ও কুন্ডু শ্রেণি ব্যবসাক্ষেত্রে অগ্রসর এবং ধনবান। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমপ্রদায় ‘সাহা’ পদবি ব্যবহার করে। কুন্ডুদের সম্পর্কে সবিশেষ জানা না গেলেও মনে করা হয় যে, তারা তিলি সমপ্রদায়ের উত্তরপুরুষ। এখনও তিলি সমপ্রদায় একটি অনুন্নত শ্রেণি হিসেবে হিন্দু সমাজে বিদ্যমান আছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, লোককাহিনীর চাঁদ সওদাগরও ছিলেন একজন গন্ধবণিক।

চনরিওয়ালা: বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। তালের ডগা কেটে তৈরি হতো পাখা। পাখা ছোট-বড় সব মানুষই ব্যবহার করতেন। কিন্তু অর্থবিত্তশালীরা পাখাকে সাজিয়ে- গুছিয়ে ব্যবহার শুরু করলো। বনেদিদের পাখাকে যারা বর্ণাঢ্য রূপ দিতো তাদের বলা হতো চনরিওয়ালারা। তারা তালের পাখাকেই বিশেষ ধরনের পাখায় রূপান্তর করতেন সঙ্গে চামরও প্রস্তুত করতেন। তখনকার ঢাকায় শিয়া মতাদর্শীদের আধিক্য ছিল। তখনও নানাবিধ উপাচারে মহরমের তাজিয়া মিছিল হতো। মিছিলে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের হাতে পাখা বা চামর থাকত। 

সাজানোর ব্যাপারে পাখা ও চামরের ব্যবহার ছিলো অনবদ্য। আবার হিন্দুদের পূজায় প্রতিমাকে বাতাস করা বা গা থেকে মশা, মাছি তাড়ানোর কাজে নিয়োজিত থাকতো পাখা ও চামড়। এসব উত্সব-আনন্দকে বর্ণাঢ্য করতে চামর ও পাখার ব্যবহার ছিল। তবে এখন বৈঠকী গান, রামায়ন, রয়ানি, কীর্ত্তনের দিন ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়ায় চামরের দেখা মেলে না। পাখাও এখন গল্পে এসে ঠেকেছে। বিদ্যুত চলে গেছে গ্রামের গহিন তল্লাটে। তাই চনরিওয়ালাদের বংশ পরিক্রমা খুঁজলে দেখা যাবে তারা অন্য কোনো পেশা খুঁজে নিয়েছেন। আধুনিকতার ইতিহাসটা এমনই।

বলদিয়া: ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল এদের পারিবারিক পেশা। বলদিয়ারা ব্যাপারী নামেই ছিল এদের পরিচিতি। লাম্বরি, লাম্বাদি বা বানজারা নামেও এদের পরিচিতি ছিল। বানজারা ও লাম্বাদিরা ছিল হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষ। সেকালের নাজুক নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে এরা দলেবলে চলাচল করত এবং এই দলে ভাঁড় বা সঙরাও থাকত। এরা বাড়ি বাড়ি বিক্রি-বাট্টা করতে সঙদের ব্যবহার করে পরিস্থিতি আনন্দমুখর করে ফেলতো। তার ওপরে চলতো বিক্রিবাট্টা। এককথায় বলা যায় বণিক তবে লোকজনে ডাকতো ব্যাপারী বলে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বলদের ব্যবহার ছিল বলেই হয়তো নাম বলদিয়া হয়েছে বলে অনেকের চিন্তা। বলদে টানা গাড়িতে করে এরা দ্রব্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে যেত। এরা ছিল ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। খুবই পরিশ্রমী ছিল এই ব্যবসায়ীরা। 

শাঁখারি: শাঁখারি পেশাটি ঢাকার ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। ঢাকার একটি পুরনো পেশাজীবী শ্রেণি শাঁখারিরা। শাঁখারিবাজার নামটি শাঁখারি পেশার থেকে এসেছে। যেমন এসেছে শাঁখের করাতও। শঙ্খের থেকে কেটে শাঁখা বানানো হয়। শঙ্খ কাটার ওই করাত দুপাশেই সমান কাটে বলে ‘শাঁখের করাত’ নাম হয়েছে। শাঁখারিরা ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এমন বলা যাবে না। তবে এ পেশায় খুব কম লোকই টিকে আছে। ভারত থেকে যে শাঁখা আসে তার দাম হাতে বানানো শাঁখার চেয়ে কম। তাই ঢাকার শাঁখারিরা নামমাত্র টিকে আছে। শাঁখার ব্যবসা থাকলেও এদের খবর আর রাখে না কেউ। ঢাকার শাঁখারিদের নামডাক ছিল খুবই এবং ৮৫৩ জন শাঁখারির বাস ছিল ঢাকায়। সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। এভাবে টিকে আছে শাঁখারিরা।

মাহুত: হাতির চালককে বলে মাহুত। মাহুতদের বসবাসের এলাকাটাই মাহুতটুলী। মাহুতদের আগমন ঘটে মোগলদের সময়ে। মোগলদের সামরিক বাহিনীতে হস্তিবাহিনী ছিল। এসব হাতিকে পিল বলা হতো। ঢাকার যেখানে হাতি রাখা হতো ওটার নাম পিলখানা এ কারণেই। হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড প্রভৃতি জায়গার নামও মোগল কোম্পানি আমলের স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হাতি পরিচালনাকারীর পরিচিতি ছিল মাহুত নামে। মাহুতটুলীকে মাহুতদের আবাসস্থল বলে মনে করা হয়।

কাহার: পালকিবাহকদের কাহার বলা হতো। কাহারদের চলার তালই ‘কাহারবা’ নামে  উহুম না-উহুম না- বলে এরা পালকি বয়ে চলতো। অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এ পেশার মানুষদের সামাজিক মর্যাদা তেমন ছিল না। কাহাররা পালকি বাড়িতে নামিয়ে বিভিন্ন ধরনের গান গাইতো। এগুলো এক ধরনের বিয়ের গীত হিসাবে ধরা হয়। ঢাকায় ঢুলি ও কাহার নামের পালকিবাহকরা ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ভালোভাবেই টিকে ছিল, এমনকি বিংশ শতকেও পালকির চল এ এলাকায় ছিল। প্রধানত হিন্দু তবে অংশত মুসলিম সমপ্রদায়ের কাহারদের সন্ধান মেলে ইতিহাসের পাতায়। পালকি এখন আর চোখে পড়ে না। দু-একটা কখনো দেখা গেলেও সেগুলো সাধারণ মজদুর শ্রেণির মানুষরা বহন করে। কাহাররা এ পেশায় আর নেই। নবাবগঞ্জের বারোয়াখালী বাজারের পাশে কাহাররা থাকলেও এ পেশার কথা বললে তারা অসন্তুষ্ট হয়।

শেষ কথা: সভ্যতা যেখানেই আলো ফেলেছে সেখান থেকেই ক্রমশ কিছু পেশা কিছু বস্তু, কিছু সংস্কৃতি বাদ পড়েছে। সেসব বস্তুকে সেকেলে, আর সংস্কারকে কুসংস্কার বলেছে কেউ কেউ। দিন যতো বদলোবে— প্রগতি ধারায় সমাজ ততোই এগোবে। তখন সব বিষয় যে চলবে তা নয়। যুগের চাহিদাকে মানতেই হবে। এন্ড্রয়েড ফোন হাতে নিলে আমরা পেছনের যতদূর দেখি সব পড়ে আছে। সেই ট্রাঙ্কলের যুগ থেকে এনালগ ফোন, পরে ডিজিটাল ফোন। তারপর মুঠো ফোন, তাও কত রকম হয়ে এসেছে বর্তমান অবস্থায়। নতুনকে যেমন মেনে নিতে হয়, পুরনোকে আঁকড়ে না থাকলেও বর্জনের মধ্যে এমন কোনো কৃতিত্ব নেই। এখনও ভবনের উপরে টালি বা খড়ের গাদার ঘর চোখে পড়ে। এটা বিচিত্র নয়। সব মিলেমিশে থাকাই আধুনিকতা।


মানবকণ্ঠ/এফআই