ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করে স্বাবলম্বী জামালগঞ্জের নারীরা
মুড়ি মোয়া ! শীতকালে বাঙালীর এক মুখরোচক খাবার। গুড় ও মুড়ি সমন্বয়ে ঘরে তৈরী এই মুড়ি মোয়া খুবই জনপ্রিয়। যুগ যুগ ধরে বাঙালী নারী-পুরুষ রসনা তৃপ্ত করে গুড় মুড়ি মোয়া খেয়ে আসছে। আখের রস থেকে তৈরী রশি গুড় চুলায় জ্বাল দিতে দিতে চিটচিটে করে মুড়ির সাথে মেখে তৈরী করা হতো মুড়ি মোয়া। মুড়ি মোয়ার ডাইস ছিল টিনের গোল ঢাকনা। মুড়িগুলো গুড়ের সাথে মেখে পরে টিনের মুখের ডাইসে দিয়ে চ্যাপ্টা গোলাকৃতির মোয়া তৈরী করা হতো। আর এই চ্যাপ্টা গোলাকৃতির মোয়াই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় মোয়া। কিন্তু কালের চক্রে আধুনিক ফার্স্ট ফুডের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী খাবার মুড়ি মোয়া।
তবে বাঙালীর এই ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করে একদিকে যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের উত্তর ইউনিয়নের শরৎপুর গ্রামের নারীরা তেমনিভাবে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষায়ও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বছরের ছয় মাস এই সুস্বাধু মোয়া তৈরী হয় জামালগঞ্জের এই গ্রামে। দুই দশক আগে মুড়িও তৈরি করত এই গ্রামের নারীরা। তবে বর্তমানে সিলেট কিংবা ভৈরব থেকে মুড়ি ক্রয় করে থাকেন। সেই মুড়ি তপ্ত তরল গুড়ে মিশিয়ে দ্রুত শীতল করার পর নারী শ্রমিকেরা হাতে গোলাকৃতি মোয়া বানায়। যার নাম মোয়া কিংবা লাড়।
এই গ্রামের সনাতন ধর্মাবলাম্বী নারীরা প্রায় প্রতিটি ঘরেই একসময় মোয়া তৈরী করতেন। বর্তমানে পেশা বদল করে অনেকে অন্য পেশায় চলে গেলেও কয়েকটি পরিবার এখনো তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
সরজমিনে এই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ৭/৮জন নারী প্রতিটি ঘরে সারিবদ্ধ ভাবে বসে লোহার কড়াই থেকে গুড়ে মেশানো মুড়ি দুই হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মন্ডের মতো গোল করে বাশের তৈরি পাত্রে রাখছে। মাঝে মাঝে পাশে রাখা ছোট পাত্র থেকে সরিষার তেল হাতের তালুতে মেখে নিচ্ছে। এতো তাড়াতাড়ি তারা মোয়া তৈরী করছে মনে হয় দুটো হাত যেন এক একটি যন্ত্র। অন্য পাশে চলছে বড় আকৃতির লোহার কড়াইয়ের মধ্যে গুড়ের নালা বা তরল গুড় ঢেলে আগুনে তাপ দেওয়া হচ্ছে। পরিমান মতো মুড়ি ঢেলে বাশের কাটি দিয়ে ঘেটে বড় গামলায় রেখে দেওয় হচ্ছে। সেখান থেকে নারী শ্রমিকেরা মোয়া বানাতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যেই মোয়ার পাহাড় হয়ে যায়। পরে প্যাকেট জাত করে বড় বস্তায় করে বিক্রয় করেন ক্রেতাদের কাছে।
মোয়া তৈরীর নারী শ্রমিকরা জানান, ভোর ৬টা থেকে দুপুরে ১ ঘন্টার বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত তারা মোয়া তৈরি করেন। তারা প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কেজি মোয়া তৈরী করতে পারেন। প্রতি কেজি মোয়া তৈরিতে তারা ৪ টাকাকরে পেয়ে থাকেন। এতে প্রতিদিন ২শত থেকে আড়াইশত টাকা মজুরী পায়।
মুড়ির মোয়া তৈরীর মালিক অজিত দেবনাথ জানান, সকাল থেকে শুরু করে দুপুরে ১ ঘন্টা বিরতির পর বিকেল পর্যন্ত মোয়া তৈরীর কাজ চলে। মোয়া তৈরীতে প্রথমে চুলায় গুড় তরল করে মুড়ি মেশানো হয়। এরপর গামলায় মুড়ি ও তরল গুড় মিশিয়ে নারী শ্রমিকেরা দুই হাত দিয়ে গোলাকৃতি মোয়া তৈরী করেন। তারপর আমরা বস্তায় ভরে বিভিন্ন বাজারে পাইকারদের নিকট বিক্রয় করি। আগে আমাদের গ্রামের নারী শ্রমিকেরা মুড়ি তৈরী করত। এখন মুড়ি সিলেট থেকে পাঠালী গুড় ভৈরব থেকে নিয়ে আসি। প্রতি কেজি গুড় ১১০ টাকা এবং মুড়ি ৬৫ টাকা কেজি দরে কিনে থাকি। প্রায় ১৫ বছর যাবত এব্যবসা করে আসছি। শীতকাল শেষ হলে বর্ষকালে বাদাম, বোট ভেজে বিভিন্ন বাজারে বিক্রয় করি। আমার এখানের মোয়া লিপসা, গাগলাজুর, সেলিমগঞ্জ সাচনা বাজার, গোলকপুর, জয়নগর, নোয়াগাও বাজারে পাইকারী বিক্রয় করে থাকি। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮মন মোয়া তৈরী করে থাকি। প্রতিকেজি মোয়া পাইকারী ভাবে ৫৫ টাকা করে বিক্রয় করি। এক সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে মোয়া তৈরী করা হতো। বর্তমানে আমারা কয়েকটি ঘরে মোয়া তৈরী করে থাকি। এতে করে প্রায় অর্ধ শতাধিক নারীর কর্ম সংস্থান হয়েছে।
জামালগঞ্জ উত্তর ইউপি চেয়ারম্যান মো: হানিফ মিয়া জানান, আমার ইউনিয়নের শরৎপুর গ্রামের নারীরা মোয়া তৈরী করে বেকারত্ব ঘুটিয়েছেন। প্রতিদিন ২শত থেকে আড়াইশত টাকা রোজগার করে থাকেন। এই গ্রামের মোয়া জামালগঞ্জ ছাড়াও অন্যান্য উপজেলা থেকে পাইকররা এসে নিয়ে যায়। শীতকালে এই গ্রামের মোয়া খেয়ে অনেকে তৃপ্তি পেয়ে থাকে।
মানবকণ্ঠ/এসআর
Comments