Image description

জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল তাদের লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড নীতিমালায় (পলিসিতে) বড় ধরণের পরিবর্তন নিয়ে আসতে চলেছে। আগামী ২১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন এই পরিবর্তনের ফলে গুগলের সার্চ রেজাল্টে কেবলমাত্র সেই সব লোকাল সার্ভিসের বিজ্ঞাপনই প্রদর্শিত হবে যেগুলো গুগল বিজনেস প্রোফাইলের সাথে যুক্ত বা লিঙ্কড। 

অর্থাৎ, স্থানীয় যে সকল ব্যবসায়ের গুগল বিজনেস প্রোফাইল নেই, কিংবা থাকলেও সেগুলো লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড অ্যাকাউন্টের সাথে যুক্ত (লিঙ্কড) নয় সেগুলো গুগলের সার্চ রেজাল্টে আর দেখানো হবে না আগামী ২১ নভেম্বর থেকে। 

স্থানীয় ব্যবসায়ের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত নীতিমালায় আসন্ন এই পরিবর্তন সম্পর্কে গুগল সম্প্রতি একটি নোটিশ জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী ২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার থেকে আপনার লোকাল সার্ভিসের বিজ্ঞাপন সার্চ রেজাল্টে প্রদর্শনের জন্য এবং কাস্টমার রিভিউ দেখানোর জন্য অবশ্যই আপনার অ্যাড অ্যাকাউন্টের সাথে যুক্ত একটি গুগল বিজনেস প্রোফাইল থাকতে হবে। 

গুগলের  লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড:
গুগলের লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ করে ছোট ও ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে স্থানীয় গ্রাহকদের সরাসরি জানানোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে এই লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড। গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন ভোক্তাদের ৯৮ শতাংশ স্থানীয় পণ্য ও সেবা সম্পর্কে অনলাইনে সার্চ করে থাকে। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ সার্চ থেকেই পণ্য বা সেবা বিক্রি হয়ে থাকে বলে জানিয়েছে ফিট স্মল বিজনেস নামের ছোট  ব্যবসা শিল্প সম্পর্কিত একটি প্রকাশনা সংস্থা।

উল্লেখ্য, স্থানীয় ব্যবসায়ের বিজ্ঞাপনগুলো গুগলের সার্চ রেজাল্টে একেবারে উপরের দিকে প্রদর্শিত হয় এবং ছোট ব্যবসায়ীদের কেবলমাত্র তাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কিত ‘লিড জেনারেশন’ এর জন্যই অর্থ প্রদান করতে হয়। ফলে সাধ্যের মধ্যে সহজেই নিজেদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকদের জানাতে পারেন ছোট ব্যবসায়ীরা। তাই নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকেই গুগলের লোকাল সার্ভিসেস অ্যাডের উপর নির্ভর করে থাকে।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল:
গুগল বিজনেস প্রোফাইল হচ্ছে গুগলের বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য একটি টুল। এই টুলটি ব্যবহার করে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য যেমন তাদের পণ্য ও সেবা, যোগাযোগের মাধ্যম, ঠিকানা ও অবস্থান (লোকেশন) ইত্যাদি গুগল সার্চে ও গুগল ম্যাপসে প্রচার বা প্রোমোট করতে পারে। গুগল বিজনেস প্রোফাইলের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সহজেই তাদের গ্রাহকদের সাথে  যোগাযোগ করতে পারে, বিজনেস প্রোফাইলে কোনো পরিবর্তন আসলে তার আপডেট পোস্ট করতে পারে এবং তাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে গ্রাহকদের মতামত জানতে পারে। 

গুগল সার্চ ও ম্যাপসে নিজেদের ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য কিভাবে প্রদর্শিত হবে সেটা ব্যবসায়ীরা গুগল বিজনেস প্রোফাইলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় পণ্য ও সেবা সম্পর্কিত সার্চের রেজাল্ট পেজে আসতে হলে গুগল বিজনেস প্রোফাইলের কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে। নতুন গ্রাহক পেতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

গুগল বিজনেস প্রোফাইল তৈরির জন্য একটি যাচাইকরণ বা ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ভিডিও বা ফোনের পাশাপাশি মাঝে মাঝে গুগল থেকে পোস্টকার্ড গ্রহণের মাধ্যমেও যাচাইকরণ (ভেরিফিকেশন) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। বিজনেস প্রোফাইল তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের এভাবেই বৈধতার প্রমাণ দিতে হয়। এই যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার কল্যাণে ‘লিড জেনারেশন হাইজ্যাক’ হওয়ার মতো ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়। অর্থাৎ বৈধ বিজনেস প্রোফাইলের সম্ভাব্য গ্রাহকদেরকে ভুয়া বা ফেইক বিজনেস প্রোফাইলের মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যবসায়ে নিয়ে যাওয়ার (হাইজ্যাক) মতো বেআইনী কাজ রুখতে এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত গ্রাহকদের নেতিবাচক রিভিউ এড়াতে কিংবা নিজেদের ‘লিড জেনারেশন’ এর সম্ভাবনা বাড়াতে এই ধরণের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় অসাধু ব্যবসায়ীরা।

গুগলের লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড পলিসিতে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কী?
গুগলের বিজনেস প্রোফাইল সঠিক প্রক্রিয়ায় যাচাই করার পরেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, অসাধু ব্যক্তিরা লিড জেনারেশন হাইজ্যাক, অপ্রাসঙ্গিক ব্যবসায়ের ফিডব্যাক নিজের ব্যবসায়ে এনে ‘গ্রাহক রিভিউ’ শক্তিশালী করাসহ নানা প্রকার অবৈধ কাজ করে থাকে। পুরো সিস্টেমে এই ধরণের অপব্যবহার রোধ করার জন্যই গুগল তাদের লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড পলিসিতে নতুন এই পরিবর্তন নিয়ে আসতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় একটি অতিরিক্ত স্তর যুক্ত করা হলো, যাতে করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার মাধ্যমে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়।

এই পরিবর্তনের ফলে ব্যবসায়ীরা প্রভাবিত হবেন কি?
ব্যবসায়ীরা অবশ্যই প্রভাবিত হবেন, তবে সেটা ইতিবাচকভাবে না নেতিবাচকভাবে সেটা অবশ্য নির্ভর করছে ব্যবসায়ীদের উপর। গুগলের উদ্দেশ্য হচ্ছে অসাধু ব্যক্তিদের অবৈধ কার্যক্রম রোধ করা। বিশেষ করে লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড ইকোসিস্টেমের অপব্যবহার বন্ধ করাই গুগলের মূল উদ্দেশ্য। এই পরিবর্তন তাই বৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক একটি বিষয়। 

তবে এখনই সচেতন না হলে বৈধ ব্যবসায়ীরাও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারেন গুগলের বিজ্ঞাপন নীতিমালায় আসন্ন এই পরিবর্তনের কারণে। একজন ব্যবসায়ীর যদি গুগল বিজনেস প্রোফাইল না থাকে, কিংবা প্রোফাইল থাকলেও সেটা যদি লোকাল সার্ভিসেস অ্যাডের সাথে যুক্ত না থাকে, অথবা বিজনেস প্রোফাইলে প্রদত্ত তথ্যের সাথে অ্যাড অ্যাকাউন্টের তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় সেক্ষেত্রে তার বিজ্ঞাপন গুগলের সার্চ রেজাল্ট পেজে প্রদর্শিত হবে না। তাই ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ীদের যারা লোকাল সার্ভিসেস অ্যাডের উপর অনেকাংশে নির্ভর করেন তাদের উচিত অতিসত্বর তাদের ব্যবসায়ের গুগল বিজনেস প্রোফাইল ও লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড অ্যাকাউন্ট লিঙ্কড করে নেওয়া।

ব্যবসায়ীদের যা করনীয়:
গুগল বিজনেস প্রোফাইল না থাকলে অবশ্যই একটি প্রোফাইল তৈরি করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বিজনেস প্রোফাইলে ব্যবসা সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হবে ঠিক একই তথ্য লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড অ্যাকাউন্টেও প্রদান করতে হবে। দুটো অ্যাকাউন্টই একই জিমেইল অ্যাড্রেস দিয়ে ওপেন করতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে যে ব্যবসায়ী দুটো অ্যাকাউন্টেই লগ ইন করতে পারছেন। 

লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখতে হবে ‘কারেক্ট অর ক্রিয়েট অ্যা নিউ গুগল বিজনেস প্রোফাইল’ এই মেসেজটি এসেছে কিনা। যদি এই মেসেজটি এসেও থাকে প্রথমে ব্যবসায়ীকে নিশ্চিত হতে হবে যে এর আগে তার ব্যবসায়ের গুগল বিজনেস প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে কিনা। কারণ একবার যদি বিজনেস প্রোফাইল তৈরি করা হয়ে থাকে তাহলে কোনোভাবেই দ্বিতীয় আরেকটি প্রোফাইল তৈরি করা সমীচীন হবে না। কেননা সেক্ষেত্রে আপনার অ্যাকাউন্টটি ফেইক বা ভুয়া প্রতীয়মান হতে পারে গুগলের কাছে। 

বাংলাদেশী ছোট ব্যবসায়ীদের উপর এর প্রভাব:
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর দেওয়া তথ্যমতে দেশের ই-কমার্স খাতের ৯৫ শতাংশই ছোট ব্যবসায়ী। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ছোট উদ্যোক্তাই মূলত ফেসবুক ভিত্তিক। ফলে তাদের বিজ্ঞাপনের বাজেটের সিংহভাগই খরচ হয় ফেসবুক বুস্টিং করতে। তবে একেবারে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা না হলেও মাঝারি ও কিছু কিছু বড় প্রতিষ্ঠান গুগলের লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড ব্যবহার করে থাকেন। ফলে তাদের অবশ্যই উচিত শীঘ্রই গুগলের বিজনেস প্রোফাইল ও লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড অ্যাকাউন্ট দুটি লিঙ্ক করে নেওয়া। 

বাংলাদেশের ছোট উদ্যোক্তারা গুগলের বিজ্ঞাপনের উপর তুলনামূলকভাবে কিছুতা কম নির্ভরশীল হলেও অনেকেই বিনামূল্যে গুগল বিজনেস প্রোফাইল টুলটি ব্যবহার করে থাকেন যাতে করে স্থানীয় পণ্য ও সেবা সম্পর্কিত সার্চে ও গুগল ম্যাপসে তাদের বিজনেস সাইট ভালোভাবে সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজড হয়। এই টুলটিকে দেশের উদ্যোক্তাদের উচিত গুরুত্বের সাথে নেওয়া এবং ব্যবসা সম্পর্কিত সঠিক তথ্য দিয়ে আপডেটেড রাখা।

বিশেষজ্ঞের মতামত:
গুগলের বিজনেস প্রোফাইল ও লোকাল সার্ভিসেস অ্যাড এর বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান, স্টিডি ডিমান্ড-এর প্রতিষ্ঠাতা, এবং গুগলের বিজনেস প্রোফাইল প্রোডাক্ট বিশেষজ্ঞ, বেন ফিশার গুগলের বিজ্ঞাপন নীতিমালায় পরিবর্তনের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখেন। তিনি বলেন, গুগল ফেইক বিজনেস প্রোফাইল নিয়ে বেশ বিপাকে আছে। কেননা এই সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে তাঁদের প্রচুর রিসোর্স খরচ হয়। তাই গুগল খুব করে চাইছে প্ল্যাটফর্মটির অপব্যবহার যেন বন্ধ হয়। তবে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রাথমিকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হবেন বিজ্ঞাপন নীতিমালায় আসন্ন এই পরিবর্তনের কারণে। কিন্তু তারপরেও ছোট ব্যবসায়ীরা লোকাল সার্ভিসেস অ্যাডের উপর নির্ভরশীল থাকবে বলেই মত বেন ফিশারের।

তথ্যসুত্র: ফোর্বস, কন্সট্যান্ট কন্টাক্ট, এসআর রাউন্ডটেবিল,