
বাংলাদেশে রুল অব জাস্টিসের স্থান মব জাস্টিস দখল করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ। এ সময় তারা প্রধান বিচারপতিকে দ্রুত বিচার বিভাগের সংস্কারের তাগিদ প্রদানের পাশাপাশি এখনও রাজনৈতিক সরকারের মতই বিচারপতিদের এজলাস নির্ধারণের তীব্র সমালোচনা করেন। আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ এ সময় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রদানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া কথা রাখার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘ডিসেম্বরে ইলেকশন দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন, দয়া করে তা আপনি লঙ্ঘন করবেন না। কথা দিলে কথা রাখতে হবে।‘
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দেশে চলমান ধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, আইনজীবীদের গ্রেফতার ও পেশাগত কাজে বাধা প্রদানের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) এই মানববন্ধনের আয়োজন করে এ কথাগুলো জানান বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, প্রতিদিনই পত্রিকা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসছে নারী নির্যাতন-ধর্ষণের মত লোমহর্ষক ঘটনা। চোখে পড়ছে ৮ বছরের শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করার মত ঘটনা। আছিয়ার সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের জন্য লজ্জার, আর এই লজ্জার দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে। ধর্ষণের ঘটনা দেশে মহামারীর মত আকার ধারণ করেছে, যা আমরা আইন দিয়েও থামাতে পারছি না। আর এই পিছের মূল কারণ বিচারহীনতার নজির। বিচার প্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষণের মত অপরাধ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ধর্ষকরা মনে করছে, ধর্ষণ করেও পার পাওয়া যায় এবং এই ধরনের নজির এবং বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরেও আমরা এই মহামারী মোকাবিলা করতে পারছি না। আজকে আমরা আইনজীবীরা বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত, তখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে আমাদের আইনজীবীদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে, আমাদেরকেও আত্মসমালোচনা করতে হবে। আইনজীবীদেরকে ধর্ষণ মোকাবিলায় আরও সোচ্চার হতে হবে। সমাজের ন্যাচারাল লিডার হিসেবে দেশের প্রতিটি বিষয়ে আইনজীবীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে, সেই দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আজকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হবে, বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে দেওয়া হবে। এই ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি আগেও সোচ্চার ছিল, এখনও সোচ্চার আছে। স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে মহান সংবিধান পেয়েছে সেই সংবিধানকে আমরা কোনো ভাবেই ব্যর্থ হতে দিবো না। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ২৪ এর আন্দোলন হয়েছে সেই আকাঙ্ক্ষাকেও আমাদের সমুন্নত রাখতে হবে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মো. সানজিদ রহমান শুভ বলেন, ড. ইউনুস সাহেব বলেছেন ডিসেম্বরে ইলেকশন। আমরা বলতে চাই ডিসেম্বরে ইলেকশন দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন, দয়া করে তা আপনি লঙ্ঘন করবেন না। কথা দিলে কথা রাখতে হবে।
প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি সংস্কারের বিষয়ে অঙ্গীকার করেছিলেন। কয় দফা আপনি সংস্কার করেছেন আমরা জানতে চাই। আপনারও সময় শেষ। ডিসেম্বর নাগাদ আপনিও অবসরে যাবেন, আপনার সময়ও এখন কাউন্টিং শুরু হয়ে গেছে। খুব দ্রুততম সময়ে বিচার বিভাগের সংস্কার আমরা দেখতে চাই। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় ছিল তার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মেনে নেয় নাই। বরং নানাভাবে তারা বিচার বিভাগ কুক্ষিগত করেছে নানা ভাবে ছবক দিয়েছে।
তিনি প্রশ্ন করেন, আপনি তো নিরপেক্ষ সরকার,আপনি কেনো বিচার বিভাগের উপরে হস্তক্ষেপ করছেন? কোন বিচারপতি কোন মামলা শুনবে, কোন বিচারপতি কোন মামলায় জামিন দেবে, কোন মামলায় আপনাদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া যাবে না; এগুলো তো অশনি সংকেত। তাহলে রাজনৈতিক দল আর রাজনৈতিক সরকারের সাথে আপনার তফাৎটা কোথায়?
ডিসেম্বরের আগে প্রধান বিচারপতির সংস্কার বিষয়ক যত এজেন্ডা আছে তার সবটাই কার্যকর করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আইনজীবীরা আপনার সাথে থাকবো। নিম্ন আদালতে বিচারকরা কাজ করতে পারছে না। সেখানে নানা রকম অস্থিরতা-অনিয়ম; যা আগের তুলনায় আরও বেশি হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি বাণিজ্য হচ্ছে, উচ্চ আদালতেও আমরা নানান বিষয়ে ভুগছি। অথচ বিভিন্ন সরকারের আমলে বিচারালয়ে সিন্ডিকেট ছিল, সিন্ডিকেট বাণিজ্য হত; এখন দেখছি আপনার আমলেও নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতেও নতুন করে আবার এই সিন্ডিকেট বাণিজ্য শুরু হয়েছে, এটা কোনো ভালো লক্ষণ না।
প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, আপনার কাছ থেকে বিচার বিভাগ যতটা সুফল পাবে ততটা অন্য কারও কাছে থেকে পাবে না। যেহেতু আপনার উপরে কোন রাজনৈতিক চাপ নেই, আপনি কোনো দলের না; তাই আপনার কাছে আমাদের আশা অনেক। আগে আপীল ডিভিশনকে বলা হত আওয়ামী ডিভিশন, তার আগে আপীল ডিভিশনকে বলা হত জাতীয়তাবাদী ডিভিশন; ভবিষ্যতে আমরা এধরনের কথা যেন না শোনা লাগে যেই ব্যবস্থা নিন। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পরে আমরা গুনগত পরিবর্তন চাই, সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন চাই, মানবাধিকারমূলক মানোন্নয়ন চাই; যাতে করে জনগণকে ন্যায়বিচার দেওয়া যায়। অনেক বিচারপতি অনেকের মামলা শুনতে চায় না; যা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী। শপথ রক্ষার্থে, আপনি ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করতে পারেন না। আজকে থেকে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছে, ভবিষ্যতে যদি এমন অরাজকতা অনিয়ম চলে তবে এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত চলবে।
এদিকে মানববন্ধনে উপস্থিত অ্যাডভোকেট মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, ছাত্রদের দিয়ে মবজাস্টিস চালু করে এখানে জাস্টিসের বদলে ইনজাস্টিস হচ্ছে। আমাদের রুল অব জাস্টিস নাই, যদি রুল অব জাস্টিস থেকে থাকত তবে মবজাস্টিসের মাধ্যমে কিংবা ছাত্রর জনতার মাধ্যমে মব তৈরি করে যেখানে সেখানে আমরা বিচারহীনতা আমরা লক্ষ করতেম না। আমারদের শরীরের প্রতি অধিকার, জীবনের প্রতি অধিকার তারা সেটি তারা ভঙ্গ করছে। যা জাস্টিসের নামে ইনজাস্টিস এবং চরম ভাবে আইন লঙ্ঘন করা।
Comments