Image description

কুয়াশায় মোড়া শীতের রাত। পুরনো ভাঙা দালানের মতো নিস্তব্ধ চারদিক। পোকামাকড় ছাড়া আর কিছুই জেগে নেই। সবুজ গাছগাছালিও ঠাণ্ডায় কাতর। পাখিরা সেই সন্ধ্যায় যে পাখনায় মুখ লুকিয়েছে আর বের করেনি। এমন সময় ব্যাঙের চোখের মতো আলো জ্বালিয়ে গ্রামে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকল। ঘন কুয়াশায় অ্যাম্বুলেন্সের শুধু সামনের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। বাকিটা আঁধারে মিলেছে সুড়ঙ্গের মতো। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে কালাজ সাপের মতো কালো গ্রামটি মুহূর্তেই জেগে উঠল।

গফুর চেয়ারম্যানের বউ সাবেরাও জেগে উঠল। ভীষণ শীত। সেইসঙ্গে অন্ধকার। ঘুম চোখেই সে খাট থেকে নেমে আলো জ্বাললো। চেয়ারম্যানকে ডাকল।

‘এই তাড়াতাড়ি ওঠো। এত রাতে গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটেছে। ওঠো শিগগির।’

‘আরে কী হলো। ডাকছো কেন?’

‘গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকেছে। ঘটনা কী খোঁজ নাও।’

‘কী বললা, অ্যাম্বুলেন্স? হ তাই তো।’

গফুর চেয়ারম্যান ধড়ফড় করে উঠে বসল। বাইরে বেরিয়ে তার কানে শব্দটি আরও স্পষ্ট হলো। সেইসঙ্গে মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি। এমন সময় চেয়ারম্যান দেখল দুজন লাইট নিয়ে তার বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু কারা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু টর্চ লাইটের আলোর ফোকাস দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে আলো হাতে অন্ধকারের যাত্রীদের দেখা মিলল। বারি মোল্লা ও রফিকুল।

‘চেয়ারম্যান চাচা আপনার কাছেই আইছিলাম। ভালো হইছে পায়া গেলাম। দ্রুত চলেন। গ্রামে করোনার লাশ ঢুকছে। ওই লাশ আমরা গাড়ি থেকে নামতে দেই নাই। মেম্বারকেও খবর দিছি। অষনই চইলা আসব। আপনে চলেন। আপনেরা না গেলে কোনো সিদ্ধান্ত হইতাছে না।’
চেয়ারম্যান যেতে যেতে বলল, ‘কার লাশ খোঁজ নিছস?’

‘হ, নিছি। করিম গাজীর পোলার লাশ। ও ঢাকার এক গার্মেন্টসে কাজ করতো। আগেই হুনছিলাম ওর করোনা হইছে। ওর বাপরে খবর দিছে গার্মেন্টস অলারা। বাপের হাতে লাশ তুইলা দিছে। ওর বাপও আছে অ্যাম্বুলেন্সে।’ বলল বারি মোল্লা।

‘তো অখন কী সমস্যা?’ গ্যানজাম হইতাছে ক্যান?’ চেয়ারম্যান বলল।

‘আমরা কইছি লাশ গাড়ি থেইকা নামতে পারবো না। ওই লাশ এ গ্রামে কবর দেওন যাইবো না। ‘তাইলে আমাগোরও করোনা হইবো।’ বললর ফিকুল।

‘আমরা জাইনা শুইনা তো এ কাজ করতে দিবার পারি না চেয়রম্যান চাচা।’ বারি মোল্লা বলল।

চেয়ারম্যান বলল, ‘আচ্ছা চল দেখি কী করন যায়।’

‘এই সর সর। তোরা গাড়ির কাছ থাইকা সইরা খাড়া। চেয়ারম্যন চাচা আইচে। ওনারে দেখতে দে। ওনারে বুঝতে দে।’

অ্যাম্বুলেন্সটি এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবে কোনো শব্দ নেই। অ্যাম্বুলেন্সের হেডলাইট জ্বলছে। ছাদে সাইরেন বাতি ঘুরে ঘুরে আলো দিচ্ছে। আর অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে লালছে এক ধরনের আলো জ্বলছে। গফুর চেয়াম্যান দেখল অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে করিম গাজী বসে আছে। তার পাশে লাশ। সাদা প্লাস্টিকের কাফনে মোড়া। ওই কাপড়ে বড় বড় করে ইংরেজিতে কী সব লেখা পড়া যাচ্ছে না।

‘চেয়ারম্যান সাব এ লাশ আমরা গ্রামে দাফন করতে দেব না। আমাগো মেম্বারেরও তাই মত। এখন আপনেই ফয়সালা করেন।’

‘আপনারা চুপ করেন। আমারে ঘটনাটা ভালো কনরা শুনতে দেন। তারপর তো ফয়সালা। ড্রাইভার সাব দরজা খুলেন। আমি করিম গাজীর লগে কতা কমু।’

ড্রাইভার অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতে গেলে গ্রামের লোকজন বাধা দেয়। তাকে টেনে হিঁচড়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। বলে, ‘খবরদার ড্রাইভার দরজা খুইলা দিবা না। তাইলে কিন্তুক তোমার আজ কিয়ামত হইয়া যাইব। ওই লাশ থাইক্কা করোনার জীবাণু ছড়ায়া পড়ব। আমাদেরও করোনা হইব। আপনে কি আমাদেও মারতে চান? এ গ্রামের মানুষকে মারার কোনো অধিকার আপনের নাই। আপনে লাশ যেখান থেইকা আনছেন সেখানেই নিয়া যান। লাশ আমরা এ গ্রামের মাটি ছুঁইতে দেব না। দেহি কার কত বড় হিম্মত। কার কত ক্ষেমতা।’

কথাগুলো যে চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলছে সেটা চেয়ারম্যান সাহেবের বুঝতে বাকি থাকে না। তারপরও চেয়ারম্যান এর তীব্র প্রতিবাদ করে।

বলে, ‘আমি জানি করোনার রোগীর লাশ থেইকা করোনার জীবাণু ছড়ায় না। ও আমাদের গ্রামের পোলা। এ গ্রামেই ওর জš§। ওর জš§ ভিটেয় ওর দাফন হবে এতে তো তোমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। তোমাদের সমস্যা কোথায়?’

‘কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা একটাই এ গ্রামে করোনার রোগীর লাশ নামব না।’

‘করোনায় মারা যাওয়া মানুষটি যদি তোমাদের মা, বাবা কিংবা ভাই, বোন হতো তাইলে কি এ কাজ করতে পারতা? কেমন মানুষ তোমরা? তোমাদেও কি কোনো বিবেক নাই? মায়া দয়া নাই।’ বলল চেয়ারম্যান।

চেয়ারম্যান করিম গাজীকে গাড়ি থেকে নামতে বলে। কিন্তু অন্যরা করিম গাজীকে গাড়ি থেকে নামতে নিষেধ করে। বলে, ‘খবরদার গাড়ি থেকে এক পাও বাড়াবা না। গাড়ি থেকে নামলে খবর আছে। এই গাড়িতে আগুন ধরাইয়া দেব। তখন বুঝবা কেমন মজা। ছেলেরে তো হারাইছো। অখন তোমার জীবনডাও হারাইবা। এখন ভাইবা দেখো কী করবা।’

করিম গাজী ভয়ে কাঁপতে থাকে। শীতে কুঁকড়ে যেতে থাকে। কষ্টে গলার কাছটা শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু একটুও কাঁদে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাবে- ছেলেকে নিয়ে কি সত্যিই এ গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে?

চেয়ারম্যান সাহেব করিম গাজীকে সিট ছাড়তে নিষেধ করে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমি গাড়ির জানালা দিয়েই কথা বলছি। গাজীকে বাইরে আসতে হবে না। গফুর চেয়ারম্যান ও করিম গাজী বেশ কিছু সময় একান্তে কথা বলে। চেয়ারম্যান গাজীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। হাত চেপে ধরে গাজী আর কান্না চেপে রাখতে পারে না। গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে। গাজীর কান্না দেখে মুহূর্তেই সবাই চুপ হয়ে যায়। চারদিকে আবারও যেন রাতের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। কী করবে বা কী বলবে কিংবা এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তারা বুঝতে পারে না। কেউ কেউ ভাবে- কাজটি করা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না!

গাজী কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি এ লাশ এখন কোথায় নিয়া যামু। খোকার লাশ বাড়িত আনতে চাইলে গার্মেন্টেমসর অফিসাররা বলল, সময় ভালো না। করোনার লাশ নিয়া গ্রামে গেলে সমস্যা হইতে পারে। মানুষ নানা ধরনের কতা বলতে পারে। তোমাদের ঘরবন্দি করে রাখতে পারে। এজন্য ওমর ঢাকার মধ্যে কোনো গোরস্তানে করব দিয়া দেন। আপনে বাড়িত গিয়া কইবেন, হাসপাতাল থাইকা লাশ দেয় নাই। হাসপাতাল থাইকা প্রশাসন লাশ নিয়া গেছে। অফিসারগো এই কথা শুইনা আমি খোকারে নিয়া ঢাকার কত জায়গায় ঘুরলাম। কেউ খোকারে দাফনের ব্যবস্থা করল না। প্লাস্টিকের কাপড় দেইখা সবাই বুইঝা ফালায় এ করোনার লাশ। বলে, আমাগো গোরস্তান খালি নাই। অন্য জায়গায় নিয়া যান। ওই যে ড্রাইভার, ও সব জানে। ওর কাছে হুইনা দেহেন।’

ড্রাইভারকে পেছন থেকে টানতে টানতে কেউ একজন সামনে নিয়ে আসে। তার কাছে করিম গাজীর কথার সত্যতা যাচাই করে। ড্রাইভার বলে, ‘উনি যা কইতাছেন তা সত্য। ওনারে আপনারা শুধু শুধু কষ্ট দিতাছেন। ওনার সন্তানডার আত্মারে কষ্ট দিতাছেন। লাশডারে নামাইতে দেন। আমি বিদায় হই। আমি লাশডারে নিয়া দিনরাত ঘুরতাছি আর ঘুরতাছি। আমারও তো বাড়িঘর বউ-বাচ্চা আছে।’

ড্রাইভারের এ কথা শুনে তারা একে অপরের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে। কেউ কেউ মত দিল লাশ এ গ্রামেই কবর দেয়া হোক। হাজার হলেও সে তো এই গ্রামেরই ছেলে। আবার কেউ কেউ বলল, না এটা হবে না। জেনে শুনে কমরানাকে আমরা এভাবে ঘরে ঢুকতে দিতে পারি না।
কুয়াশার জাল ভেদ করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে চারপাশ। অনেকে যে যার কাজে চলে গেছে। আবার কেউ কেউ নতুন করে সেখানে আসছে। নানা ধরনের কথা বলাবলি হচ্ছে। কিন্তু লাশ দাফনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।

ড্রাইভার সাহেব গফুর চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বলল, ‘চাচা আমারে আপনারা ছাইড়া দেন। আমি আর দেরি করতে পারছি না। আমার আরেকটি ট্রিপ ধরতে হবে। আমারে লস করাইয়া আপনাদের লাভ কী? আপনি এলাকার চেয়ারম্যান। যে যাই বলুক সিদ্ধান্ত আপনাকেই দিতে হবে।’

ড্রাইভারের এই কথা শুনে সবাই চেয়ারম্যান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গফুর চেয়রম্যান সবার উদ্দেশ্যে বলে, ‘আমি এলাকার জনপ্রতিনিধি। যা বলি তোমরা মন দিয়ে শোনো। আমরা গাড়ি থেকে দ্রুত লাশ নামিয়ে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করি। লাশ দিয়া গন্ধ ছুটতে শুরু করছে। এভাবে লাশের কষ্ট দিয়া আমরা পাপের ভাগিদার হইতাছি। আমি চাই লাশ দ্রুত দাফন করতে। তোমরা তিন-চারজন করিম গাজীর বাড়িত যাও। কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করো।’

চেয়ারম্যানের এই কথার কেউ জবাব দেয় না। কেউ কবর খোঁড়ার কাজে আগ্রহ দেখায় না। সবাই মাথা নিচু করে থাকে। এমন সময় সেখানে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার মোস্তাক হোসেন আসে। কী হয়েছে জানতে চায়। ডাক্তার সাহেবকে দেখে অনেকেই সেখান থেকে সরে যায়। মোস্তাক হোসেন গফুর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে। কথা বলে মেম্বার ও গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে। সবকিছু শুনে বলে, ‘লাশের দাফন এখানে করলে কোনো সমস্যা নেই। আপনারা বোধ হয় জানেন না করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়া মানুষের শরীর থেকে জীবাণু ছড়ায় না। লাশ ছুঁলেও কিছু হবে না। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার নাক মুখের রক্ত বা লালা যদি কারও চোখে মুখে বা নাকে লাগে তাহলে তার এ রোগ হতে পারে।’

মোস্তাক ডাক্তারের এই কথা শুনে একজন বলে ওঠে, ‘না, আমরা ডাক্তারের কতা মানি না। ওনি আমাগো ভুল বুঝাইতাছে। উনি আমাগো লগে মিথ্যা বলতাছে। উনি আমাগো গেরামের মুনষেরে ক্ষতি করবার চায়। করোনায় মারতে চায়।’ আরেকজন বলে, ‘না ডাক্তারের কতা আমরা মানি না। কেউ এক কোদালও মাটি কাটব না। খোকার লাশ এই গ্রামে দাফন হইব না।’

গাড়িতে বসে করিম গাজী বাঘের মতো হুংকার দিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল, ‘আমার খোকারে এখানে কবর দিতে চাই না। গাড়ি থেইকা আমার ছেমলরে কাউকে নামাতে হইব না। কারও এক কোদাল মাটিও খুঁড়তে হইব না। কবর খুঁড়তে হইব না। আমি গ্রাম ছাইড়া যাইতাছি। আমার খোকার কবরের ব্যবস্থা আমিই করুম। ডঞ্ছাইভার গাড়ি চালাও।’

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অ্যাম্বুলেন্সটি প্যাঁপুঁ প্যাঁপুঁ রব তুলে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে একটি নদী দেখে করিম গাজী অ্যাম্বুলেন্সটি থামাতে বলে।

‘আমারে একটু সাহায্য করবা ড্রাইবার সাব? না বলতে পারবা না। কোনো প্রশ্ন করতে পারবা না।’

‘বলেন চাচা কী করতে হবে?’

‘আমার খোকারে নামাইয়া দিতে পারবা?’

‘অবশ্যই পারব চাচা।’

তারা দুজন খোকার লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের করে। কফিনটি নদীর পাড়ে নেয়। করিম গাজী লাশের কফিন নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। প্লাস্টিকের কফিনটি ছিদ্র হয়ে যাওয়া নৌকার মতো পানিতে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। লাশটির শেষ আশ্রয় যে কোথায় কেউ জানে না!


মানবকণ্ঠ/এফআই