Image description

সমুদ্রতীর কিশোরের খুব প্রিয় জায়গা। তীরে বালির ওপর পা ফেলে কষ্টে কষ্টে হাঁটার মধ্যেই তার আনন্দ। সেটি যেমন বিশ্বের নানা সৈকতে গেলেও হবে আর কক্সবাজারের সৈকতে গেলেও হবে। সমুদ্রের জলের জোয়ার-ভাটার খেলা, জলের উচ্ছাস, বিশাল আকৃতির ঢেউ গড়িয়ে গড়িয়ে আসা, একবার সৈকত ডুবে যাওয়া আবার জল অনেক দূর সরে যাওয়া, সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগে কিশোরের কাছে। 

ঢেউয়ের গর্জন-তর্জন, ছোট ছোট পাহাড়ের মতো জলের ঊর্ধ্বমুখি গতি যখন কূলের দিকে আসে, তখন যে আতংক হয়, কিশোর সেটিতেও আনন্দ পায়। আর এসব দেখার জন্যই সে যেতে চায় প্রতিবছর কক্সবাজার। যাওয়া একবার হয়ে ওঠে। কখনও বাবা-মার সাথে। কখনও বন্ধুরা মিলে। কখনও মামার সাথে। মামা বিদেশে থাকেন। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। তার কাছেও কক্সবাজার খুব প্রিয়। নিজ দেশের সৈকত, নিজ দেশের সাগরের উপকূল, মামা খুব ভালোবাসেন। দেশে এলে একবার যাবেনই তিনি। কিশোর প্রায়শঃ হচ্ছে তার সঙ্গী। কিশোর শুনেছে কক্সবাজার পৃথিবীর সেরা সৈকতগুলোর মধ্যে একটি। আর সেটি আমাদের দেশে। এরকম সরলরেখার মতো সৈকতও নাকি আর নেই। 

মামাসহ একবার কক্সবাজারে এসে কিশোর মামাকে দেখালো সৈকতের মজার দিকগুলো। সৈকতের বিশাল বালিমাটিতে ঘুরে বেড়ায় সমুদ্রের পোকা, কাঁকড়া। মাটির সঙ্গে মিশে পড়ে থাকে ঝিনুক, ছোট ছোট পাথর আর শামুকের দেহ। কিশোর এগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে সৈকতে সময় কাটাতে চায়। মামাও তাকে উৎসাহ দেন। এইসব সৈকতের সৌন্দর্য। কুড়িয়ে নিয়ে ঘরে সাজিয়ে রাখতে পারো। ঝিনুকের মালা গাঁথতে পারো। শামুকগুলো সাদা কালো এবং নানা রকমের নকশা করা। একটা পাত্রে একসঙ্গে অনেকগুলো শামুক রেখে দেখো, কি ভালো লাগে। 

মামা বললেন, সাগর তলার মনি-মুক্তা অনেক মূল্যবান সম্পদ। সমুদ্রতীর, সমুদ্র সৈকত, সমুদ্রের তলায় খুঁজে পাওয়া মনি-মুক্তা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। পর্যটন একটা বড় বাণিজ্যিক কাজ। সব দেশই চায় এই পর্যটন দিয়ে অনেক করবে। একদিকে যেমন মানুষের আনন্দ উল্লাসের জায়গা হবে অন্যদিকে অর্থনৈতিক লেনদেনও হবে অনেক। তাই সৈকত শুধু আনন্দের নয়, আয়েরও একটি বড় উৎস। মামা ধীরে ধীরে বোঝালেন কিশোরকে। 

কিশোর মামাকে বললো, তার মনে হয় কক্সবাজারের মতো এতো সুন্দর সৈকত আর নেই। মামা বললেন, এটি মনের ব্যাপার। তোমার মন যদি বলে তোমার জিনিসটিই শ্রেষ্ঠ, সেটি সত্য। এটা অনুভূতি। তাহলে মামা পৃথিবীর অন্যদেশের সৈকতগুলো নিয়ে কিছু বলো। 

মামা বললেন, দ্যাখো, আমাদের এই বঙ্গোপসাগর একটি উপসাগর। কিন্তু পৃথিবীর সব মহাসাগরকে তুমি জানো। আটলান্টিক, প্রশান্ত, ভারত-এইসব মহাসাগর ছুঁয়ে আছে শত শত উপকূল এবং সৈকত। এরা ছড়িয়ে আছে আমেরিকা, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকায়। এইসবের আমরা কতটা দেখেছি? 

মামা একে একে কিছু সৈকত নিয়ে কথা বললেন, পর্তুগালের আলগার্ভ ইউরোপের সেরা সমুদ্র সৈকত হিসেবে সবাই চেনে। পর্তুগালের নাম শুনলে চোখের ওপর ভেসে ওঠে বিশ্বখ্যাত জনপ্রিয় ফুটবলার রোনালদোর মুখ। পশ্চিম আলগারর্ভ এর সাগরিস থেকে অডিসেইক্স পর্যন্ত উপকূল একটি চমৎকার সমুদ্র সৈকত। মামা লিসবন ভ্রমণে গিয়েছিলেন এবং এই সৈকত দেখে এসেছেন। মামা কক্সবাজারের চাইতে এই সৈকতে বেশি আনন্দ পেয়েছেন বলেছিলেন। কিশোর এর খুব ইচ্ছা লিসবনের এই সৈকতটি দেখতে যাওয়া। সে জানে না তার এই ইচ্ছা কোনদিন পূরণ হবে কি না। কেমন করে যাবে, এসব না ভেবেই কিশোর সৈকত ভ্রমণ নিয়ে কথা বলে। তার কাছে শুধু সৈকতের তথ্য । সে যেনো সৈকত গবেষক। মামা যেনো তার ডাটার উৎস। 

কিশোরই ধরিয়ে দিলো, পর্যটকরাই পর্তুগালকে বলে সাগরকন্যার দেশ। 

পর্তুগালের উত্তর-পূর্বে স্পেনের সীমান্ত বাদে পুরো দেশজুড়ে আইবেরিয়া উপদ্বীপ আটলান্টিক সাগর দিয়ে বেষ্টিত। পুরো উপকূলজুড়ে আছে অসংখ্য সৈকত। এই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিলেই গন্তব্য আমেরিকার নিউইয়র্ক-মামা যোগ করলেন সেই সাথে। 

কিশোর এটিও জানে যে, সুইজারল্যান্ড বিশ্বের এক অপূর্ব সুন্দর দেশ। আল্পস পর্বতমালার সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে দেশটিকে। 

মামা বললেন, অনেকেই মনে করে এখানে কোনো সৈকত নেই। অথচ এখানে আছে অনেকগুলো সমুদ্র সৈকত। দশটি সেরা সৈকতের মধ্যে আছে, ইয়ক্স ভাইভস, বেইনসদে পাকুইজ, বেলেরিভ প্লেজ, লাউসেন, লিডো লুসার্ণ, আসকোনা লিডো, স্ট্যান্ডব্যাড মিথেনকুই , টাইফেনব্রুনেন বিচ, ওয়াডেনস উইলসহ অনেকগুলো সৈকত। প্রত্যেকটি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। প্রত্যেকটি চোখকাড়া বালুকাময় উপকূল যেখানে রোদের বৃষ্টিতে শুয়ে বসে থেকে সবাই ভিজে যায়। স্ফটিক স্বচ্ছ জলে ডুব খেলায় মেতে ওঠে। যারা সুইজারল্যান্ড ভ্রমণে যায়, তারা একটি দুটি সৈকত ভ্রমণ করে আসে। সারাদিন কাটায় সৈকতের বালিতে। 

মামা যোগ করলেন, এরকম আমেরিকার নানাদিকেও সৈকত আছে। মায়ামি বিচ, নাম শুনলেই বিস্ময়ে ভরে ওঠে মন। এর সঙ্গে আছে ভার্জিনিয়া বিচ। এটি দীর্ঘতম আনন্দ সমুদ্র সৈকত হিসেবে গিনিস বুকে তালিকাভুক্ত। মায়ামি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর। এটি আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে। মায়ামিকে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সৈকত শহর বিবেচনা করা হয়। মায়ামির অর্থনীতি, বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ফ্যাশন, গণমাধ্যম, বিনোদন এর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। মায়ামি সমুদ্র বন্দর। আর এটি পৃথিবীর সবচাইতে বড় সমুদ্র বন্দর। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আলাস্কার উপকূল দীর্ঘ এক সমুদ্র সৈকত। 

কিশোর মামার কাছে একমনে শুনছে সৈকত নিয়ে কথা। পাচ্ছে নানা তথ্য। মামা বললেন, সেরা সমুদ্র সৈকত আছে ইউরোপের গ্রীসে। সাগর তীর অনেক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। সোনালি সাদা কিংবা গোলাপি বালি কাচের মতো স্বচ্ছ জল, চারপাশের প্রকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয় করে তুলেছে গ্রীসের সৈকতকে। আইসল্যান্ডের কৃষ্ণবালি, থাইল্যান্ডের রূপ, বাহামাসের গোলাপি বালি, নাভাগিও বিচ, হোয়াইট হ্যাভেন বিচ, এল নিদো বিচ, প্রইয়া দ্যু সেন্তো, তুরুম বিচ, গ্রেস বে, সেভেন মাইল বিচ, মায়া বিচ, বারাদেরো বিচ, বিশ্বের সেরা বিচগুলোর মধ্যে উচ্চারিত নাম। 

কিশোর বললো, ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তামনিকা বিচ, ব্রাজিলের কোপাকাবানা বিচ, ফ্লোরিডার ডেটোনা বিচ, দক্ষিণ আফ্রিকার বুলডারস বিচতো প্রায়ই আলোচিত। অনেকের যাওয়া-আসা আছে, এসব সৈকতে। 

মামা সৈকত নিয়ে কথা বললেন, অনেক তথ্য দিলেন এবং বললেন, সৈকতের শেষ নেই। তবে এটা ঠিক বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত হচ্ছে কক্সবাজার। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘ কথাটি ঠিক নয়। বিশ্ব রেকর্ড থেকে আমরা দেখছি, এবং গিনিস বুকেও আছে, ব্রাজিলের প্রাইয়া দো ক্যাসিনো বিশ্বের দীর্ঘতম সেকত। মামা বললেন, আবেগে আমরা মূল তথ্য থেকে সরে যাই। আমরা যে  সৈকতকে ভালোবাসি সেটিও প্রশ্ন করার মতো। 

কিশোর বললো, সেটি কি মামা। আমাদের কি করা উচিত? আমাদের সৈকতকে আমাদের সত্যি সত্যি ভালোবাসা চাই। সৈকতকে পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। পর্যটকদের জন্য বিপন্মুক্ত ও নিরাপদ রাখা চাই। সৈকতের প্রাকৃতিক অবয়বকে ঠিক রাখা চাই। সৈকতকে কৃত্রিম অবকাঠামো দিয়ে ভরিয়ে রাখতে চাই না। আমাদের এখানে তো এসবই হচ্ছে, কিশোর বললো। শুধু ভালোবাসলে চলবে না। ভালোবাসার বস্তুটিকে ভালো রাখা চাই। 

মামা বললেন, সবচাইতে দীর্ঘ, সবচাইতে সুন্দর, সবচাইতে আকর্ষণীয়— এসব বলার সঙ্গে সঙ্গে যাতে আমরা ভালোবাসা দিয়ে সৈকতকে সুন্দর রাখতে পারি, সেটিই আমাদের করা উচিত। যেসব সৈকতের কথা আমরা বললাম সেগুলো তাদের চেহারাটা আমাদের দেখা উচিত। 

এসব তো সরকারের কাজ মামা। 

তা ঠিক, মা বললেন। আমাদের যতটুকু করার আছে, ততটুকু কি আমরা করি? আমরা প্রতিনিয়ত ময়লা ফেলতে থাকি সমুদ্রের জলে। খাবার খেয়ে উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে রাখি সৈকতে। সৈকত ঘেঁষে ঘর বানাচ্ছি, ছোট হয়ে আসছে সৈকতের প্রসারতা। 

কিশোরের চোখ খুললো যেনো। কিশোর ভাবলো, শুধু নিজ দেশের সৈকত নিয়ে অতিকথন নয়, তার প্রতি ভালোবাসার কথা নিয়ে ও গবেষণা করবে। বিশ্বের সব সৈকতের রূপ নিয়ে গবেষণা করে কিশোর পথ দেখাবে, আমাদের সৈকতকে আমরা কেমন ভালোবাসা দেব।   


মানবকণ্ঠ/এফআই