Image description

মহান ভাষা সৈনিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ছায়ানটের সভাপতি বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অধ্যাপক ড. সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের পুরো সময়ই কাটিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও লোকসংগীত প্রসারে।

বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ সন্‌জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। মঙ্গলবার বিকেল ৩টার পর তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব এবং পণ্ডিতদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব সন্‌জীদা খাতুন বাঙালি পরিচয় অন্বেষণ ও গঠনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

সন্‌জীদা খাতুন ছোটবেলা থেকেই সংগীত ও সংস্কৃতি কর্মে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন।

১৯৬১ সালে স্বামী বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের মধ্যদিয়ে ষাটের দশক থেকে সংগীত ও বাঙালি সংস্কৃতি জাগরণের আন্দোলনে কাজ করেছেন তিনি।

সন্‌জীদা খাতুনের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষক হিসেবে। শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ইডেন কলেজ, কারমাইকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শেষে অবসরে যান।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সন্‌জীদা খাতুন রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর সাভারের জিরাব গ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সংস্কৃতি কর্মীও ছিল। তাঁরা ভারতের আগরতলা শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। তারপর ৫ মে, ১৯৭১ সালে কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ছায়ানটের মাধ্যমে সারাদেশে সংগীত ও সংস্কৃতি কর্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ গঠন করেন। সংগীত, সংস্কৃতি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর।

রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও লোকসংগীত প্রসারে কাজ করা সন্‌জিদা খাতুন ১৯৬২ সালে রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করে সংগীত ও সংস্কৃতির উন্নয়নেই বেশি সময় কাটান তিনি।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সন্‌জীদা খাতুন বহু পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ।

সন্‌জীদা খাতুনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, অতীত দিনের স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান, ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, জননী জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনের দিনগুলি, জীবনবৃত্ত ইত্যাদি।

সন্‌জীদা খাতুনের বাবা সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন। মা সাজেদা বেগম সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং একজন দক্ষ অনুবাদক ছিলেন।