Image description

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক সংকট দেখছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সংবিধান মেনে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ সম্ভব নয়। নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হলে সেটিও হবে সংবিধানের বাইরে। আর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের আগে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি বলে মনে করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে গেল কয়েকদিন বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাঁর পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নিজ থেকে পদত্যাগ করবেন, নাকি সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে, এটাই এখন মূল আলোচনা।

চলমান পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের আগে জাতীয় ঐকমত্য গঠন জরুরি।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক উমামা ফাতেমা বলেন, ‘হুট করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ যে চলমান সমস্যাগুলোর সমাধান নয় সেটা বুঝেই, তাঁর পদত্যাগের ব্যাপারে সরকারকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হবে। তবে এর জন্য জাতীয় ঐকমত্য গঠন জরুরি।’

তবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক সংকট দেখছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সংবিধান অনুসরণ করে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করতে গেলেও তৈরি হবে জটিলতা।

এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, ‘এটি একটি সাংবিধানিক সংকট। যেখানে রাষ্ট্রপতির মূল সমস্যাটা দাঁড়াচ্ছে, তিনি কোথায় পদত্যাগ করবেন। যদি তিনি এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেন, তাহলে যে সংবিধানের আলোকে এই অন্তর্বর্তী সরকার চলছে সেটিও একটি সংকটের মুখে এসে দাঁড়াবে।’

প্রসঙ্গত, একটি রাজনৈতিক ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখ’‑এ প্রকাশিত রাষ্ট্রপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে গত সোমবার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তোলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। পরে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান, আইন উপদেষ্টার এ বক্তব্যই সরকারের বক্তব্য।

মঙ্গলবারই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণজমায়েত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এ সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার দাবি জানান।

অন্যদিকে, একই দিন রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ করেন কয়েকটি সংগঠনের নেতা‑কর্মীরা। সন্ধ্যায় তারা ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকজন আহতও হন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের আশ্বাসে বঙ্গভবন ছাড়ে তারা।

এ সময় হাসনাত বলেন, ‘আগামী দুই দিন বুধবার ও বৃহস্পতিবার সবার সঙ্গে কথা বলে এমন একজনকে রাষ্ট্রপতি করা হবে, যাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকবে না। তারপর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। এ জন্য আমাদের দুই দিন সময় দিন।’

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি বুধবারও দিনভর আলোচনায় ছিল। বিএনপির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা বলতে পারি, এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলে আপনারা জানতে পারবেন।’

আবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম জানান, ‘রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাঁর পদে থাকবেন কি না সেটা আইনি নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হবে।’ বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ না করতেও তিনি সকলকে আহ্বান জানান। 

তবে এই মুহূর্তে রাজনীতির মাঠের সবচেয়ে বড় শক্তি বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, দলটি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় না। 

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ শঙ্কা জানিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। এতে নির্বাচন বিলম্বিত হবে। তাই বিএনপি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায় না।’

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসররা নানা কৌশলে-নানাভাবে দেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট তৈরির চেষ্টা করছে।’

তবে বিএনপির দুই নেতার এই দুই বক্তব্যকে রাষ্ট্রপতি প্রশ্নে দলটির অস্পষ্ট অবস্থান বলে আখ্যা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কিত বক্তব্যে তিনি বিএপির প্রতি পরিষ্কার বক্তব্য আহ্বান করেছেন। একইসঙ্গে বলেছেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কোনো বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী নই।’ তবে একই সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক নেতা বলেন, ‘রাজপথেই সমাধান হবে চুপ্পু (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) কোথায় যাবে।’

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলা আছে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সংসদ কার্যকর থাকতে হবে। সংসদ সদস্যরাই কেবল রাষ্ট্রপতি অপসারণ বা অভিসংশন করার ক্ষমতা রাখেন। আবার রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তিন মাসের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করতে হবে। 

এই মুহূর্তে এর কোনোটিই সম্ভব না। কেননা সংসদ কার্যকর নেই, স্পিকারও নেই। তবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মনে করেন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি ইনচার্জে থাকেন। তাঁকে তখন রাষ্ট্রপতি হতে প্রস্তাব করতে হবে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তাঁর পদত্যাগেরও সুযোগ নেই । সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জন আকাঙ্ক্ষার আলোকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে।’

গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর গত ৮ অক্টোবর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনেকেই পদত্যাগ করেছেন।