বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রাখার পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এ কাউন্সিল যাচাই-বাচাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ পাঠাতে পারবে। সংবিধান অনুসারে, প্রধান বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতির সমন্বয়ে এ কাউন্সিল গঠিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য জানায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
সুপ্রিম কোর্ট বলছে, বর্তমানে অন্তত ১৫ জন বিচারপতিকে বিচার কাজের বাইরে রাখা হয়েছে। কাউন্সিলে কয়েকজন বিচারপতির বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাচাইয়ের কাজ চলছে। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে এখনও কোনো অভিযোগ পাঠানো হয়নি।
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীতে তা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদকে। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রুলের শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ।
পরে একই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে।
গত ২০ অক্টোবর সেই রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ।
এর ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায় বহাল থাকল। একইসঙ্গে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরল বলে জানান আইনজীবীরা।
রিভিউ নিষ্পত্তির পর ওই দিন নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল মো.আসাদুজ্জামান বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ করলে বা পেলে প্রাথমিক একটি অনুসন্ধান করা হবে। কাউন্সিল যাচাই বাছাই করে দেখবে অসদাচরণ বা দুর্নীতি (অর্থনৈতিক বা বুদ্ধিভিত্তিক) পাওয়া গেল কি না; পাওয়া গেলে প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির। এখানে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মেকানিক্যাল। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো অসদাচরণ প্রমাণিত হয়েছে কি হয়নি, তা-সহ সুপারিশ পাঠানো।
যা বলা ছিল সংবিধানে
ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিলের আগে সংবিধানের এ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়, এ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী না মেনে কোনো বিচারককে তার পদ থেকে অপসারিত করা যাবে না।
একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে, যা এ অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লেখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ, তাদের নিয়ে গঠিত হবে।
তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এরূপ কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করে, অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকে অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজ করতে অসমর্থ হন, তাহলে কাউন্সিলের যারা সদস্য আছেন, তাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।
কাউন্সিলের দায়িত্ব হবে- বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা। কোনো বিচারকের অথবা কোনো বিচারক যে পদ্ধতিতে অপসারিত হতে পারেন, সে পদ্ধতি ছাড়া তার পদ থেকে অপসারণযোগ্য নন, এরূপ অন্য কোনো পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা।
যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে রাষ্ট্রপতির এমনটি বোঝার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক- শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন।
অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং তদন্ত ফল জানানোর জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
কাউন্সিল তদন্ত করার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যদি এমন প্রতিবেদন দেয় যে, তার মতে উক্ত বিচারক তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হয়ে পড়েছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন, তাহলে রাষ্ট্রপতি আদেশের মাধ্যমে ওই বিচারককে তার পদ থেকে অপসারণ করবেন।
এ অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পরোয়ানা জারি ও নির্বাহের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতো এর একই ক্ষমতা থাকবে।
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments