Image description

নিজেদের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। চলতি মাসের (ডিসেম্বর) শেষের দিকে সুপারিশ ও প্রস্তাবনা সম্বলিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে পারেন তারা। এরইমধ্যে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনারদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও সেরেছে সংস্কার কমিশন। ওইসব বৈঠকের আলোচনার নিরিখে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে ইসি। 

বিশেষ করে নির্বাচনের আগে অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো যেমন- সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন দলের নিবন্ধন দেয়া, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করাসহ নির্বাচনী অন্যসব কর্মযজ্ঞ শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি। নেয়া হয়েছে আইন ও বিধিমালা সংস্কারের উদ্যোগ। এসব কাজ সম্পন্ন করতে চার নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে চারটি পৃথক কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন আয়োজনের সবুজ-সংকেত পেলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন তফসিল ঘোষণা করা যায় সেলক্ষ্যেই সব কাজ গুছিয়ে রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইসির একাধিক কর্মকর্তা।  

নির্বাচনী কাজ সামলাবে চার কমিটি: কাজের সুবিধার্থে নির্বাচন কমিশন (ইসি) চার নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে ৪টি নতুন কমিটি গঠন করেছে। নির্বাচন কমিশন বিধিমালা, ২০১০-এর বিধি ৩-এর উপ-বিধি ২-এর উপ-বিধি অনুযায়ী ৪টি কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটির মধ্যে কমিটির মধ্যে ৮ সদস্যের ‘আইন ও বিধি সংস্কার কমিটির’ প্রধান করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছুউদ। এই কমিটির অন্যতম প্রধান কাজ হবে বিদ্যমান নির্বাচনী আইনসহ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সকল আইন ও বিধিবিধান পর্যালোচনা করা এবং সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করা। 

নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে ৯ সদস্যের আরেকটি কমিটি। এ কমিটির কাজ হবে নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস এবং দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়। নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারকে সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও মনিটরিং এবং সুবিধাভোগীদের সাথে আলোচনা সংক্রান্ত ৬ সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহকে ১০ সদস্যের জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন পরিচালনায় তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগ সংক্রান্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে।

যা বলছে ইসি: নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রি.জে (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমরা একটা পলিটিক্যাল প্রসেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সেই প্রসেসটা আমি নিশ্চিত, আপনারা হয়তো প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনেছেন-যে এ সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দেয়া। তবে যে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সেগুলো হতে হবে। সবারই তো উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনে যাওয়া। যথাযথ সময়ে নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলবো। তিনি বলেন, এটা শুধুমাত্র দায়িত্ব নয়। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা। ইনশাআল্লাহ আমরা এ দায়বদ্ধতা পূরণ করবো। 

কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মনে করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমরা কমিশন সমন্বিতভাবে মনে করি মোর দ্যান দ্য চ্যালেঞ্জ, আমরা মনে এটা অপরচ্যুনিটি। চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই আছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্যই আমরা এখানে আছি। এটা অপরিচ্যুনিটি ভাবছি এ জন্য, জাতি একটা ক্রান্তি লগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই, একটা ভালো নির্বাচন করা ছাড়া। আমরাই সেই ব্যক্তিরা, যাদের আল্লাহ এখানে নির্ধারণ করে পাঠিয়েছেন। 

এদিকে গত ৪ ডিসেম্বর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থার ঘাটতি আছে। সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে। যে জায়গায় আমরা এখান দাঁড়িয়ে আছি- কীভাবে একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন করা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপট আমরা সবাই জানি। মেজর ডেফিসিয়েন্ট যেগুলো যার মধ্যে ঘাটতি আছে এগুলো আমরা সবাই জানি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় নির্বাচন কখন হওয়া উচিত এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সময় নিয়ে কোনো আলোচনা এখানে হয়নি। নির্বাচন কীভাবে হওয়া উচিত, নির্বাচন ভালো করার জন্য কি করা দরকার সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

প্রস্তাবনা যাচ্ছে সরকারের কাছে: নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তুত করছে। এ মাসের শেষ অথবা আগামী মাসের প্রথম দিকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এসব সুপারিশ পেশ করা হবে। 

সূত্র আরও জানায়, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা চালু, সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, নারী আসনে সরাসরি ভোট, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেয়া, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতির বিলোপ এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে ভারসাম্য আনাসহ অন্তত ২০টি বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশ করতে যাচ্ছে ড. বদিউল আলম মজুমদার কমিশন। এর মধ্যে অনেক সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিটিতেও থাকতে পারে। ইসি সংস্কার কমিশন গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত করা অন্তত ৩০টি বৈঠকের মতামত ও প্রস্তাবনার আলোকে এসব সুপারিশমালা তৈরি করা হচ্ছে। 

এ ছাড়া অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- ভোটে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করতে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত করা; নির্বাচন এবং প্রার্থিতা বাতিলে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো; প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত এবং পোস্টাল ব্যালট কার্যকর করার সুপারিশ করা; নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন অডিট করা; হলফনামার তথ্য যাচাই করা; নির্বাচনী অভিযোগ দাখিল ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা; নির্বাচনী মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেঁধে দেয়া ও ইসির ভূমিকা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত বিধিবিধান সংস্কার করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে সুপারিশমালায়।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান সম্প্রতি এ বিষয়ে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যে আইনে ইসি গঠন হয়েছে, এবারও সেটা দিয়েই ইসি গঠন হয়েছে। এর দুটো কারণ, সরকার ইলেকশন প্রসেসে নিয়ে নিতে চায়। আর আমরা যখন প্রস্তাব দেবো, সেটার পর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করবে, শেষে লম্বা প্রসেস এটা। তাহলে ইসি গঠন দেরি হয়ে যাবে অনেক, যদি আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী হয়। আমার ধারণা সরকার যেহেতু আন্তরিক, সে কারণে প্রিভিয়াস আইনে করছে। নির্বাচন প্রসেসের দিকে এগোচ্ছে দেশ, এই সিগন্যালও দিলো সরকার’।

নির্বাচনের প্রস্তুতি সরকারেও: নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংস্কার হলেই নির্বাচনের জন্য সরকার প্রস্তুতি নেবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিনিধি দলের সাথে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠককালে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে চলতি মাসেই ঘোষণা আসতে পারে- এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করতে খুবই আগ্রহী, আমরাও নির্বাচন করতে আগ্রহী’। 

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পুরনো প্রচলিত সমস্যা পরিহারে নির্বাচন সংক্রান্ত কতিপয় সংস্কার নির্বাচনের আগেই শেষ করা জরুরি। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তাদের প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাদের সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে হবে। 


তিনি বলেন, সরকার যদি এখন নির্বাচন দেয়, তবে সেটা হবে সেকেলে এবং তখন পুরনো সব সমস্যা আবারও ফিরে আসবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৫টি বিভিন্ন কমিশন রয়েছে এবং সরকার আশা করছে, চলতি মাসের শেষ থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এই কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন পেশ করবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংস্কার হলে সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।