Image description

বকেয়ার ভারে জর্জরিত তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত বকেয়ার পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানাসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া পড়েছে ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

খাত হিসেবে বিল খেলাপির শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতের সরকারি-বেসরকারি কোম্পানির কাছে বকেয়া পড়েছে ৬ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির কাছে ৩ হাজার ৭০৬ কোটি ৯১ লাখ এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ৩ হাজার ৪১ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

তিতাস গ্যাসের মার্চ মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া পড়েছে ৮ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বকেয়ার শীর্ষে মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড (৪৫০ মেগাওয়াট)। কোম্পানিটির বকেয়া গ্যাস বিল আটকে রেখেছে ১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।

সামিট গ্রুপের ৪ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে পাওনা দাঁড়িয়েছে ৯৩৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানির কাছে ৬২০ কোটি ৫২ লাখ টাকা, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি-২ এর কাছে ৩০৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। ইউনিট গ্রুপের ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের কাছে ১৯৭ কোটি ৯ লাখ টাকা।

সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে খেলাপির শীর্ষে রয়েছে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশের ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কোম্পানিটির পরিচালনাধীন হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ১ হাজার ৬৩৬ কোটি ২৩ লাখ, সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকা, সিদ্ধিরগঞ্জ ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ২৭৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বকেয়া পড়েছে।

বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়ার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বকেয়ার পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে দুবাই ভিত্তিক কোম্পানি আরএকে সিরামিকস। কোম্পানিটির কাছে ৬ মাসের বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হোসাইন পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলসের কাছে ৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সময়ের দিক থেকে সবার শীর্ষে রয়েছে এবিএস গার্মেন্টস লিমিটেড। কোম্পানিটির কাছে ১৭৬টি ইনভয়েসের বিপরীতে বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকার উপরে। নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নোমান নিট কম্পোজিটের বকেয়া পড়েছে ১৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে কোম্পানিটি বিল পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রমও। বড় অংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। দফায় দফায় মিটিং হয়, আলোচনা হয়, সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।

আর বেসরকারি কোম্পানিগুলো এতদিন আওয়ামী লীগের নেতাদের দাপট দেখাতেন, এখন আমলা ও বিএনপি নেতাদের ব্যবহার করে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বকেয়া ঝুলে রাখতে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। বিল না দিতে একেক সময় একেকজনকে ব্যবহার করে আসছেন। কখনও উপদেষ্টার দপ্তর, কখনও সচিবের দপ্তর, কখনও আমলা, কখনও রাজনীতিবিদ, এমনকি পুলিশকেও ব্যবহার করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই একবার তদ্বির করে বকেয়া পরিশোধের জন্য ৩ থেকে ৪ মাস সময় নেন। সেই সময় পেরিয়ে গেলে আবার নতুন কাউকে ধরে চাপ দেন। এভাবে বছরের পর বছর সময় পার করে দিচ্ছেন। প্রত্যেকবারেই যিনি তদ্বির করেন, বলেন— “কয়েক মাস সময় দেন, আমার সম্মানে।” এভাবে তদ্বিরকারীদের মুখ রক্ষা করতে গিয়ে ক্লান্ত তিতাসের কর্মকর্তারা। কোনো ক্ষেত্রে ইচ্ছে না থাকলেও প্রভাবশালীদের চাপে অনেকের ফাইল এড়িয়ে চলে।

আবার ক্ষেত্রবিশেষে নিজের আখের গোছাতে কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছেন অনেক কর্মকর্তাও। তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে তদ্বিরের লাইন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে গ্যাসের বিলের টাকাকে মূলধন বানিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছেন অনেকে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেছেন, “আমরা জোরালো অভিযান পরিচালনা করছি। আগের তুলনায় বকেয়া কমে এসেছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে তদ্বিরের কারণে আমরা বিরক্ত।”